চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

বধ্যভূমি সংরক্ষণে টাকার সঙ্কট !

মিজানুর রহমান 

১৩ ডিসেম্বর, ২০২১ | ১:১২ অপরাহ্ণ

দেশের যেই বধ্যভূমিতে সবচেয়ে বেশি হত্যাকা- ঘটেছে সেই পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি স্বাধীনতার ৫০ বছরেও। অন্তত ২০ হাজার মুক্তিযোদ্ধার রক্তে ভেজা এই বধ্যভূমি সংরক্ষিত না হওয়ায় হতাশ মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মীরা। উচ্চ আদালতের আদেশের পরও বধ্যভূমিটি সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা। তবে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, নগরীর পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে ‘আন্তরিকতা নিয়ে’ কাজ করছেন তারা।

এই বধ্যভূমি সংরক্ষণে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কাছে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে না আসায় ‘সব প্রস্তুতি’ থাকা সত্ত্বেও  ভূমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করতে পারছেন না তারা। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান পূর্বকোণকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা বরাদ্দ হয়নি দেখে আমরা অধিগ্রহণ করতে পারছি না। এই অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ পাবো। রিভাইসড বাজেটে টাকা ধরা হয়েছে। আমাদের সব কার্যক্রম রেডি। জাস্ট টাকা বরাদ্দ হলেই আমরা অধিগ্রহণ দ্রুততার সাথে করে ফেলবো। ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে ভূমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেবো’।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাহাড়তলীর বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য প্রজন্ম-৭১ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই বধ্যভূমি সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। এরপর ১ দশমিক ৭৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য প্রাথমিকভাবে ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু ২০০৫ সালে তখনকার বিএনপি জামায়াত নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার ওই প্রকল্প বাতিল করে টাকা ফেরতের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের ওই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে জাফর ইকবাল, মুনতাসির মামুন, মিলি রহমান, শাহরিয়ার কবির, পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে প্রাণ হারানো আলী করিমের সন্তান গাজী সালেহউদ্দিনসহ আট বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট করেন।  ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারি হাইকোর্ট আট বিশিষ্ট নাগরিকের করা রিট নিষ্পত্তি করে দিলে আবেদনকারীরা এর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করেন। আট বিশিষ্ট নাগরিকের আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারকের বেঞ্চ ২০১৪ সালের ৪ মার্চ চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণের আদেশ দেন।

তবে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের সাড়ে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত পাহাড়তলী বধ্যভূমি সংরক্ষণে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। উল্টো বধ্যভূমির জায়গায় নানা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বধ্যভূমি রক্ষা পরিষদসহ মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতিকর্মীরা। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহানগর ইউনিট কমান্ডার মোজাফফর আহমদ পূর্বকোণকে বলেন, ১৫-২০ বছর ধরে বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য আন্দোলন করছি। কিন্তু এখনো বধ্যভূমি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। অল্প টাকার জন্য দেশের যেই বধ্যভূমিতে সবচেয়ে বেশি হত্যাকা- ঘটেছে সেটি সংরক্ষণ হবে না? তিনি বলেন, শুধু ডিসেম্বর এলে এ নিয়ে সবাই কথা বলে। এরপর চুপচাপ হয়ে যায়। আমাদের অনেক মুক্তিযোদ্ধা, বধ্যভূমিতে প্রাণ হারানো অনেক শহীদ পরিবারের সদস্যরা বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ না হওয়ার আক্ষেপ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদেরও বয়স হচ্ছে। বধ্যভূমি সংরক্ষণ নিয়ে যে টালবাহানা চলছে, বধ্যভূমি সংরক্ষণ মৃত্যুর আগে দেখবো বলে মনে হচ্ছে না।

পাহাড়তলী বধ্যভূমি রক্ষা পরিষদের নেতা মোস্তফা কামাল যাত্রা অভিযোগ করে পূর্বকোণকে বলেন, জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণেই পাহাড়তলীর বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। বধ্যভূমি দখল করে যারা অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন- তাদের সুবিধা দিতেই জেলা প্রশাসন বধ্যভূমি সংরক্ষণে উদ্যোগ নিচ্ছে না। অধিগ্রহণের কথা বলে সময়ক্ষেপণ করছে।

নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী পূর্বকোণকে বলেন, দেশের বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে পাহাড়তলী বধ্যভূমিতেই সবচেয়ে বেশি হত্যাকা- ঘটেছে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে এই বধ্যভূমিতে। এতো মানুষের আত্মত্যাগ যেই ভূমিতে সেটি সংরক্ষণ না হওয়া দুঃখজনক। আমরা হতাশ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট