চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র : অবাক চোখে নির্বাক দৃষ্টি!

জাহেদুল আলম, রাউজান

১ অক্টোবর, ২০২১ | ১:০১ অপরাহ্ণ

কেউ দেখছেন টিভি। কেউ পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছেন। কেউবা আবার পুকুর ঘাটে বসে কাটাচ্ছেন শেষ জীবনের অলস সময়। নারীদের কেউ মেঝেতে বসে, কেউ চৌকিতে বসে প্রকৃতি-পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এরা সবাই বৃদ্ধ। পরিবারের সদস্যদের ‘বোঝা হওয়া’ থেকে মুক্তি দিতে কেউ এসেছেন  স্বেচ্ছায়, আবার কেউ এসেছেন স্ত্রী-সন্তানদের অবহেলায়। শেষ জীবনে ঠাঁই হিসেবে বেছে নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমকে। অথচ সব মানুষেরই প্রত্যাশা থাকে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে একটি হাসিখুশি, আনন্দে জীবনের শেষ সময়টা কাটানোর। গতকাল রাউজানের নোয়াপাড়ায় একমাত্র বৃদ্ধাশ্রম আমেনা-বশর বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে এমন দৃশ্যে চোখে পড়ে।

এসব প্রবীণদের কারো বয়স ৭৫-৮০ বা কারও প্রায় ১শ। কেউ কেউ আছেন বয়স পয়ষট্টি ঊর্ধ্ব। তাদের পারিবারিক এত দুঃখ কষ্টের পরে এই বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় মিললেও তাদের কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগে-সরকারের অবহেলা। করোনার প্রায় দুইবছর পেরোলেও এসব বৃদ্ধদের কেউ পায়নি টিকা। এ দুঃখে প্রবীণরা সরকারের কাছে শুধু টিকা নয়, কোন সহযোগিতাই আর আশা করেন না। এই বৃদ্ধাশ্রমে প্রায় দুইবছর আগে এসেছিলেন চাঁদপুরের সিরাজুল ইসলাম (৭০)। এতো বছর কেউ দেখতে আসেনি তাকে।

গত চারদিন আগে বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি মারা গেছেন। তাকে বৃদ্ধাশ্রমের তত্ত্বাবধানেই দাফন করা হয়। রাঙ্গুনিয়া মরিয়ম নগর এলাকার নজরুল ইসলাম (৭১) প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এই বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হয়েছিলেন। একসময় ব্যবসা করে ভালোই জীবন কাটিয়েছেন। স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সব থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের অবহেলায় তাকে বৃদ্ধাশ্রমে আসতে হয়। তিনি ক্ষোভে-দুঃখে বলেন ‘কেউ দেখতে আসেনা। যেখানে আছি সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়, খাবার দেয় সবকিছু দেয়। কিন্তু ভারী রোগ হলে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফোন করে হাত পাততে হয়।’ তিনি বলেন ‘প্রবীণ দিবস হলেও আমাদের কোন সুফল নেই। এতোদিনে আমরা একটি করোনা প্রতিরোধক টিকাও পেলাম না। আর কি আশা করবো।’

ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ তপন চৌধুরী। কানে শুনেন না, চোখেও কম দেখেন না। জীবনে বিয়ে শাদিও করেননি। ভাই, আত্মীয়-স্বজন থাকলেও বৃদ্ধাশ্রমে আসার পর তাকে কেউ দেখতেও আসেনি একবারও। অনেকটা প্রতিবন্ধী হয়ে দিন কাটছে তার।

খাগড়াছড়ি জেলার কাঞ্চনা বালা দে (৭০) বলেন ‘কপাল খারাপ, তাই ৫ বছর আগে এখানে এসেছি। এটিই এখন সবকিছু আমার। বয়স্ক ভাতা থেকে যা পাই, তা দিয়ে জটিল রোগের চিকিৎসা মেটাই। সরকার প্রবীণদের নিয়ে আরো ভাবলে আমরা উপকৃত হতো।’

প্রায় ১শ বছর বয়সী হামিদা বেগমের বাড়ি হাটহাজারী। তিনি একসময় কেজি স্কুলে চাকরি করতেন। ৪ বছর আগে বয়সের ভার নিয়ে এখানে আসেন। একমাত্র ছেলে অসুস্থ। স্বজনরা তাকে দেখতেও আসেনা। তাকে সহযোগিতা করারও যেন কেউ নেই।’

শোভা দত্ত (৬৪), রাজস্থলীর উইসাংপ্রু মারমা (৭০), রেণু লতা চাকমা (৮০), কোকিলা চাকমাও (৮০) দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এ বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। তারা বলেন, ‘নোয়াপাড়া আমেনা-বশর পুর্নবাসন কেন্দ্রে আমরা ঠাঁই পেয়ে আমরা বৃদ্ধ বয়সে ভালো আছি। তবে জটিল রোগ, আত্মীয়-স্বজনরা দেখতে না আসা আমাদের ভোগায়।

কেয়ারটেকার মো. ফারুক ও মানু বাবু বলেন ‘বিশাল এই বৃদ্ধাশ্রমটি প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে কয়েকটি ভবনে প্রবীণদের জন্য ৬০টি সিট রয়েছে। বর্তমানে এখানে ১১ জন পুরুষ ও ৮ জন নারী প্রবীণ রয়েছে। নারী-পুরুষদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

জানা যায়, ২০১৪ সালে রাউজান নোয়াপাড়া পথেরহাটের পশ্চিম দিকে নান্দনিক পরিবেশে আমেনা-বশর পুর্নবাসন কেন্দ্রটি গড়ে তোলেন এলাকার সমাজসেবক শামসুল আলম।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট