চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

মন্তব্য প্রতিবেদন

কোনো এম্বুলেন্স আর যেনো গৃহবন্দী না থাকে

ডা. সাজেদুল হাসান

১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ৪:০৯ পূর্বাহ্ণ

পত্রিকান্তরে জানা গেল ২০১৯ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি আইসিইউ এম্বুলেন্স প্রদান করা হয় (২০২১ সালের ৩১ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়)। অনুরূপ একটি অব্যবহৃত এম্বুলেন্সের সংবাদ আগের দিন একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তবে সেটি রাজশাহী মেডিকেলের। ধারণা করি দুটি এম্বুলেন্সের উৎস একই। খোঁজ করলে এরকম সহোদর আইসিইউ এম্বুলেন্সের কাহিনী যে আরও আবিষ্কৃত হবে না, তা নয়। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ঘটনাটি আমাকে একাধিক কারণে বিচলিত করে। প্রধান কারণ হচ্ছে- এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরকারি হাসপাতাল, ৮০ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাণিজ্যিক রাজধানীসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি জেলার সাধারণ জনগণের চিকিৎসার ভরসাস্থল। দ্বিতীয়ত, সূত্রে বর্ণিত পত্রিকার ভাষ্যমতে বিগত ১৯ আগস্ট এই হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ওয়াহিদুর রহমান দায়িত্ব পালন শেষে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে এ হাসপাতাল আইসিইউতে ভর্তি হন। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে তাঁকে ঢাকা প্রেরণের জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে শ’খানেক গজ দূরে অবস্থানরত হেলিকপ্টারে পৌঁছানোর জন্য তাঁকে বেসরকারি আইসিইউ এম্বুলেন্সের শরণাপন্ন হতে হয়েছিলো যার ভাড়া ৯ হাজার টাকা। ডা. ওয়াহিদ হয়তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নন তাঁকে বহনকারী হেলিকপ্টারের ভাড়া হয়তো তাঁকেই বহন করতে হয়েছে। কিন্তু নিজ হাসপাতালে দেড় বছর ধরে মজুদ থাকা আইসিইউ এম্বুলেন্স ব্যবহারের সৌভাগ্য তাঁর হলো না। এই মেডিকেলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসাবে এর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার সাথে আমার মত হাজার হাজার ছাত্র, শিক্ষক ও চিকিৎসকের আবেগজড়িত তাই স্বভাবগত নিশ্চুপ থাকতে ব্যর্থ হয়েছি।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, এই বিশেষায়িত এম্বুলেন্স পরিচালনের জনবল তাঁদের ছিল না তাই এটি চালু করা যায়নি। কিন্তু কি সেই জনবল? একজন প্রশিক্ষিত ডাক্তার, একজন নার্স সেই সাথে ড্রাইভার। যদি ছুটি বিকল্প ও অসুস্থতা বিবেচনায় নেই তাহলে এর তিনগুণ জনবল ধরে সর্বাধিক ৩ জন ডাক্তার, ৩ জন নার্স ও ৩ জন ড্রাইভার। সেটি সংগ্রহ করা কঠোর হলো? স্বাস্থ্য দপ্তরে চাকুরিজীবী মাত্রই জানেন প্রেষণ নামক একটি মুশকিল আহসান পদ্ধতি এই দেশে প্রচলিত আছে। সেটির সার্থক প্রয়োগ এইক্ষেত্রে সম্ভব ছিলো। নতুবা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে হাসপাতালের বিদ্যমান জনবল হতেই এরকম ক্ষুদ্র একটি দল গঠন করা যেত। বেসরকারি আইসিইউ এম্বুলেন্স যদি প্রশিক্ষিত জনবল দিয়ে পরিচালিত হতে পারে তাহলে সরকারিভাবে কেনো সেটি সম্ভব হলো না। বলা হচ্ছে জনবল মোটামুটি প্রস্তুত আছে ডাক পেলেই তাঁরা সাড়া দেবেন। এই কঠিন করোনাকালে শতসহ¯্র জনমানুষের আহাজারির মধ্যেও আইসিইউ এম্বুলেন্স ডাক পেলো না! এই হাসপাতালের একজন চিকিৎসকেরই ১০০ গজ পথ পরিক্রমার জন্য বেসরকারি এম্বুলেন্সের সহায়তার প্রয়োজন হলো! নাকি সচল এম্বুলেন্স প্রকাশিত হলে কোনো কোনো গোষ্ঠীর স্বার্থহানির আশংকা সৃষ্টি হয়?

সূত্রমতে রাজশাহী মেডিকেল কর্তৃপক্ষ বলেছেন- তাঁদের জনবল কাঠামোতে এম্বুলেন্স পরিচালনার পদসমূহ অন্তর্ভুক্ত নেই এবং এই এম্বুলেন্সের চাহিদাও তাঁরা দেননি। আমি জানি না চট্টগ্রাম মেডিকেলেরও অনুরূপ অজুহাত আছে কিনা। তবে চাহিদা ব্যতিরেকে উপহার হিসাবেও এরকম জরুরি উপকরণ প্রদান করা যায়। সেইক্ষেত্রে অবশ্য ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষের এটি ব্যবহার উপযোগী ক্ষেত্র প্রস্তুত কিনা বা প্রস্তুত না থাকলে সেটির ব্যবস্থা করা দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুঃখজনক হলেও সরবরাহকারী ঠিকাদার গোষ্ঠীর চাহিদামত ক্রয়-প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়, এটি এখন অনেকটাই দৃশ্যমান।

সরকার জনগণের চিকিৎসা সুবিধা সহজলভ্য, সুলভ ও ব্যয়-সাশ্রয়ী করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলের দরিদ্র ও সাধারণ নাগরিকের কল্যাণের জন্য ব্যয়িত অর্থ যেনো কোনো অবহেলা, দায়িত্বহীনতা আর দুর্নীতির চোরাগলিতে হারিয়ে না যায়, আর যেনো কোনো এম্বুলেন্স এভাবে গৃহবন্দী না থাকে, দেশের সচেতন নাগরিক হিসাবে এটিই আমাদের কাম্য।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট