চট্টগ্রাম রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস

৩০ আগস্ট, ২০২১ | ৮:২১ পূর্বাহ্ণ

বর্ণালী দ্যুতিময় জীবন। যে জীবন অনেক অনেক জীবনের আলোকবর্তিকা। যে আলোকবর্তিকা অনেকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। টিম টিম পিদিম নয়। নয় রাতের আঁধারের চকিত বিদ্যুৎ। তা দিবসের প্রস্ফুটিত বিচ্ছুরণ। ‘আলোকের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে, এ জীবন পূর্ণ কর দহন দানে’র প্রতিফলন সেইজন রবিবার সকাল এগারোটায় জীবনের পাঠ চুকিয়ে মহা-জীবনের সরণিতে পথচলা শুরু করলেন। তার সম্বন্ধে বিন¤্র শ্রদ্ধা আর অপার বিস্ময়ের অনুরণন উঠছে হাজারো মনে, যার শেষ হবে না কখনও। অধ্যাপক লুৎফুর আনোয়ার কাদেরী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় গুচ্ছের এই প্রাক্তনী অত্যন্ত তুখোড় ছাত্র ছিলেন। ফাইনাল এমবিবিএস-এ সেই সময়ের পূর্বাঞ্চল প্রদেশে প্রথম স্থান অধিকার করে স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন। তারপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইএমওর দায়িত্ব পালন শেষে যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষণে যান এবং রয়াল কলেজ অব এডিনবরার এফআরসিএসে ভূষিত হন। অতপর নিউরোসার্জারিতে বুৎপত্তি অর্জনের পর রয়াল ইনফারমারিতে যোগ দেন। প্রসঙ্গত, নিউরোসার্জারি খুব কঠিন শাস্ত্র। সত্তরের দশকের শেষের দিকে দেশের ডাকে যুক্তরাজ্যের ধার আর ভারের দারুন কাজ ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে যোগদান করেন। আমি তখন ইনসার্ভিস ট্রেইনি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ১৫তম গুচ্ছের প্রাক্তনী। আইপিজিএমআরের চার তলার বন্দীদশা আর কয়েকজন নিউরোসার্জনের সীমাবদ্ধতার বাইরে নিউরোসার্জারিকে অবমুক্ত করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। যার শুরু তার নিজের শিক্ষায়তনে। আমরা তা দেখছিলাম আর আপ্লুত হচ্ছিলাম ওয়ানমেন নিউরোসার্জারির অদম্য শুরু। এ ব্যাপারে আজ দেশ অনেক এগিয়ে বলা চলে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ যেনো তারই প্রতিসুর, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরিষ শাখায় পাতায় পাতায় ফাগুন মাসে ফুল ফোটাবার এই খেলা’। অধ্যাপক কাদেরী ফুল ফুটিয়ে গেছেন সব অঙ্গনে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিজ্ঞান আর সেবায়।

অধ্যাপক কাদেরী কিন্তু গ-ির ভিতরে আবদ্ধ ছিলেন না। পেশার বাইরে সব ভালো কাজে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সমিতি, আড্ডাবাজি, বন্ধুসংঘ, মানুষের কল্যাণ ইত্যাদি সবকিছুতে ছিলেন সবার আগে। ছিলেন কল্যাণকামী অনেক প্রতিষ্ঠানের কখনও কর্ণধার কখনও সংগঠক কখনও উপদেষ্টা। সব মতের সব পথের সবাইকে নিয়ে সংঘবদ্ধভাবে চলতে পারতেন তিনি। যা এক বিরল গুণ। মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন সংকটাপন্ন সময়ে এই গুণের সফল প্রভাব পাওয়া যেত। পেশার সম্মান রক্ষায় তিনি সবসময় ছিলেন সবার সামনে, নেতৃত্বে। দেশের জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ সব ফলনধর্মী প্রতিবাদী কাজে ছিলেন তিনি। যার জন্য তিনি অনেকবার কর্তৃপক্ষীয় নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। ছাত্র, প্রশিক্ষণার্থী, সহকর্মী, রোগী সবার সাথে তিনি ছিলেন অমায়িক ও অবিরূপ এবং দারুণ প্রভাবক। অধ্যাপক কাদেরীর মতো স্বর্ণালী-বর্ণালী জীবন খুব বিরল। যেমন হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘যে জীবন দোয়েলের-ফড়িংয়ের মানুষের সাথে তার কোনকালেই দেখা হয় না’। অধ্যাপক কাদেরীর মতো হয়তো আর কোন অবয়বের সাথে দেখা হবে না।

সর্বক্ষেত্রে সর্বদিগন্তে ঝকঝকা ফকফকা একজন অধ্যাপক কাদেরী আজ আমাদের সকল নিবেদনের বাইরে। আমাদের কোন অঞ্জলি তাকে স্পর্শ করবে না, প্রয়োজনও নেই। কিন্তু আমাদের মনের গহীনে তিনি বিচরণ করবেন ছড়াবেন প্রত্যুষের বা প্রদোষের সোনালী আলো বা রাতের জোৎস্না। আমাদের ক্ষণ-প্রতিক্ষণের ইচ্ছার মর্মর ধ্বনি হোক তার জীবন ও কাজ। কাল থেকে কালান্তরে ছড়িয়ে পড়ুক। ছড়িয়ে যাক আমাদের হৃদয়ের অনুভব ও দোলা।
‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট