চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিআরবি বাঁচিয়ে নিঃশ্বাস নিতে দিন চট্টগ্রামকে

১৫ জুলাই, ২০২১ | ১২:২০ অপরাহ্ণ

অনেক বছর ধরে চট্টগ্রামের প্রতি এক ধরণের নগর অবিচার করে আসা হচ্ছিলো। এই শহরের প্রাকৃতিক পরিচয় এর পাহাড়গুলো, এর খালগুলো। নির্বিচারে পাহাড় কাটা হয়েছে। ঐতিহ্য-সচেতন, পরিবেশবাদী উদ্যোগের অভাবে চাক্তাই খাল পরিণত হয়েছে একটি বীভৎস নর্দমায়। খোলা জনচত্বরগুলোকে মনে করা হয়েছে ব্যবসাভিত্তিক উন্নয়নের সুযোগ হিসেবে। চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রের আউটার স্টেডিয়ামের কথা ভাবুন। এখানে উচ্চবিত্তের সুইমিং পুল বানিয়ে জনগণের মাঠকে বিকৃত করা হয়েছে, তাদের নাগরিক অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। সারা পৃথিবীতে যখন টেকসই নগরায়ণের লক্ষ্যে সবুজ আর পাবলিক প্লেস সংরক্ষণের সামাজিক আন্দোলন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন চট্টগ্রামে চলছে সবুজ হরণ আর জনগণের জমি দখলের উৎসব।
এই অশুভ প্রতিযোগিতার সর্বশেষ নাটক দেখছি চট্টগ্রামের ভৌগোলিক কেন্দ্রে অবস্থিত সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, যেটা সিআরবি নামে সুপরিচিত, সেই স্থানের প্রশান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ আর পাবলিক প্লেস-এর নগর ঐতিহ্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি পাঁচশ শয্যার হাসপাতাল ও একশ আসনের মেডিকেল কলেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। জমির মালিক রেলওয়ে চুক্তি করেছে ইউনাইটেড হাসপাতালের সাথে এই বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। আশি লাখ মানুষের এই শহরের অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ুক, এটা সব শহরবাসীরই কাম্য। আরেকটি মানসম্পন্ন মেডিকেল কলেজ হলে শহরেরই লাভ সব দিক থেকে। কিন্তু এই বিশাল হাসপাতাল আর কলেজটি এখানে কেন হতে হবে? সিআরবি এলাকাটি চট্টগ্রামবাসীর ফুসসুসের মতো। এখানে এসে সবাই খুঁজে পায় শরীর-সঞ্জীবনী নগর অরণ্য, উন্মুক্ত মাঠ, শিরীষতলার নির্জনতা, আর উঁচু-নিচু ভূমির ভৌগোলিক কবিতা। একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, পহেলা বৈশাখ, আর আরো অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পীঠস্থান এই সিআরবি। এটি কোনো বিল্ডিং নয়, এটি কোনো ময়দান নয়। সিআরবি চট্টগ্রামের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রভূমি, আরণ্যিক উৎস, আর পাহাড়ঘেরা এই শহরের একটি ছোট্ট সংস্করণ। এখানে কেন হতে হবে উচ্চবিত্তের ইউনাইটেড হাসপাতাল আর মেডিকেল কলেজ?
একটি হাসপাতাল আর কলেজ তো শুধু তাদের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এ দুটো প্রতিষ্ঠান আমূল পরিবর্তন করে ফেলবে এই এলাকার প্রাকৃতিক প্রশান্তি আর নীরব সৌন্দর্য। তৈরি করবে বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়িক বলয় যেমন ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, পার্কিং, খাবারের দোকান, মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য বিভিন্ন ধরণের দোকান, মেডিকেল দালাল, আরো কত কিছু। যানবাহন চলাচল বেড়ে যাবে বহুগুণ। থাকবে না প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সেই চিরচেনা সিআরবি। সিআরবির ব্যবসায়ীকরণ হবে চট্টগ্রামের নিম্নমুখী নগরযাত্রার অন্যতম প্রতীক।
ইউনাইটেড হাসপাতাল আর কলেজ তৈরি করা হোক শহরের বাইরে যেটা দিতে পারে চট্টগ্রাম শহরের সুস্থ সম্প্রসারণের দিক নির্দেশনা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত হবে নগরের প্রাকৃতিক আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান দেখানো। মালিকানা মানে যা খুশি তা করার অধিকার নয়। রাষ্ট্র বা নগরের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো উন্নয়ন ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভূমিতেও হওয়া উচিত নয়। উন্নত বিশ্বের ইতিহাস-সংবেদনশীল শহরগুলোতে ব্যক্তিগত ইমারতেরও কোনো পরিবর্তন করা যায় না অনুমোদন ছাড়া। কেউ পরিবর্তন করতে চাইলে সেই পরিবর্তনের ফলে কি ধরণের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া হবে তা তৃতীয় গোষ্ঠী দিয়ে নিরেপেক্ষভাবে নির্ধারণ করাতে হয়। ইউনাইটেড হসপিটালের ক্ষেত্রে ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ নিজেই নিয়োগ দিয়েছে এই তৃতীয় পরামর্শককে। এটা যে নিরেপক্ষ হবে না তা বলাই বাহুল্য।
সিআরবির ওপরে চট্টগ্রামবাসীর নাগরিক অধিকারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জনসম্পৃক্ত উন্নয়ন বা নগরায়ণ প্রগতির চালিকাশক্তি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন আর দাবি দুটোই জানাচ্ছি, তারা যেন বিষয়টিকে তাদের পলিসির আওতায় আনেন।

 

লেখক : স্থপতি ও স্থাপত্য ইতিহাসবিদ,
অধ্যাপক, ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অফ আমেরিকা, ওয়াশিংটন ডিসি
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর ইনক্লুসিভ আর্কিটেকচার এন্ড আরবানিজ্ম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট