চট্টগ্রাম সোমবার, ২০ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

সিআরবিতে হাসপাতাল ইস্যু : ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে চট্টগ্রাম

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৫ জুলাই, ২০২১ | ১১:৫৫ পূর্বাহ্ণ

নগরীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ ইস্যুতে ক্ষোভ বাড়ছে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনসহ পরিবেশ সচেতন চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, নাগরিক সমাজ, পরিবেশবাদী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। মতাদর্শ ভুলে এর প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। অবিলম্বে হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধে আন্দোলন কর্মসূচি এবং আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণাও এসেছে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে।
গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলনকারীদের প্রতিবাদ বক্তৃতা ও বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও আজ বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। এরই অংশ হিসেবে নাগরিক সমাজের ব্যানারে ‘চট্টগ্রামের প্রকৃতি ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে সিআরবিতে হাসপাতাল চাই না’ শীর্ষক অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। আজ বিকেল ৪টায় সিআরবির সাত রাস্তার মোড়ে এই কর্মসূচি পালিত হবে। সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের দাবি এসেছে অন্য সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও।
গতকাল বুধবার মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী দুটি সংগঠন হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর পৃথক দুটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের পক্ষ থেকে হাসপাতালের জন্য প্রস্তাবিত জায়গায় ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থান’ উল্লেখিত একটি ব্যানার টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতাল নির্মাণের প্রতিবাদে সিআরবি এলাকায় বৃক্ষরোপণ করেছেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন।
উদ্ভূত পরিস্তিতিতে গতকাল রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক এবং হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা পরিবেশ নষ্ট করে এবং চট্টগ্রামবাসীর ক্ষতি হয় এমন কোনো প্রকল্প সরকার গ্রহণ করবে না বলে জানান। এ বিষয়ে বিশিষ্টজনদের মতামত নিয়ে দ্রুত একটি সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রামবাসীর সামনে পুরো বিষয়টি তুলে ধরা হবে বলেও আওয়ামী লীগ নেতারা জানান।
প্রসঙ্গত রেলওয়ে ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ এন্ড কোম্পানি লিমিটেড পিপিপিতে যৌথভাবে সিআরবির ৬ একর জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করবে। ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল এবং ১০০ আসন বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ নির্মাণে ইতোমধ্যে দুই প্রতিষ্ঠান নিজেদের মধ্যে চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রকল্পের অবকাঠামোগত কাজ শুরু হবে।
এদিকে আন্দোলনকারীরা বলছেন- অপরূপ নৈসর্গিক অঞ্চল, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকলা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ সিআরবি এলাকায় রেলওয়ের কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য একটি হাসপাতাল আছে। আরেকটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে এ এলাকার পাহাড়, টিলা, শতবর্ষী গাছ কাটা পড়বে। প্রাণীরা তাদের আবাস হারাবে। মানুষের যাতায়াত বাড়বে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে। সিআরবি এলাকা তার শতবছরের বৈশিষ্ট্য হারাবে। এ কারণে পরিবেশ ধ্বংস করে সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল চান না তারা।
বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার : চিকিৎসা মানুষের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং একটি হাসপাতাল স্থাপন যেকোনো শহরের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ব্যাপার। হাসপাতাল স্থাপনের ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় এবং নেইও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এর স্থান নির্ধারণ। হাসপাতাল প্রকল্পের চাহিদা মোতাবেক জমি ও ভবিষ্যৎ বর্ধিতকরণের জন্য জমি যাতে একত্রে পাওয়া যায় এবং তার সাথে সাথে অন্যান্য সাপোর্টিং সুবিধাও পাওয়া যায় তা বিবেচনায় আনা। কিন্তু চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল গড়ে তোলা একেবারে অযৌক্তিক। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানে সিআরবিকে কালচার এন্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই), চট্টগ্রাম চ্যাপ্টার অবিলম্বে এই হঠকারী ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টি : সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে হাসপাতাল গড়ে তোলার উদ্যোগের প্রতিবাদে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন সংগঠনের জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ আব্দুল নবী ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অশোক সাহা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি নগরীর সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে একটি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার পর ইতোমধ্যে হাসপাতাল নির্মাণের প্রাথমিক প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এর ফলে সিআরবির পাহাড়-টিলা, শতবর্ষী বৃক্ষসমূহ ধ্বংসের মুখে পড়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং সিআরবির প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় সরকারকে এই মারাত্মক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সন্তান কমান্ড : সিআরবি এলাকার পরিবর্তে অন্য কোনো স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের দাবিতে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহানগর ও জেলা ইউনিট কমান্ড এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড মহানগর ও জেলা কমিটির উদ্যাগে সিআরবির সাত রাস্তার মোড়ে গতকাল বুধবার এক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড মহানগর কমিটির আহবায়ক সাহেদ মুরাদ সাকুর সভাপতিত্বে ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মো. সরওয়ার আলম চৌধুরী মনির পরিচালনায় সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মহানগর ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আহমদ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ : সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের জোরালো দাবি জানিয়েছেন বীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফজল আহমদ। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, সিআরবির শতবছরের স্মৃতিবিজড়িত বটবৃক্ষ চট্টগ্রামের ইতিহাস বহন করে। চট্টগ্রামের মুক্তমনা মানুষের সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। এই বটবৃক্ষের তলায় একটু বিশ্রাম নেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, পথশিশুসহ প্রবীণ ব্যক্তিরাও। সর্বদিক বিবেচনায় রেলওয়ে ও বেসরকারি উদ্যোগে এ হাসপাতাল কোনমতে কাম্য নয়।
রেল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : হাসপাতালটি নির্মাণ করা হবে সিআরবির শিরিষতলা এবং সাত রাস্তার মোড় থেকে দূরে গোয়ালপাড়া এলাকায়। ফলে এই প্রকল্পের জন্য কোনো শতবর্ষী গাছ কাটার সম্ভাবনা নেই। গোয়ালপাড়া এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করা হলে সিআরবি এলাকার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট হবে না। শিরিষতলায় বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানসহ অন্য সাস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনেও কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না।

 

পূর্বকোণ/এসি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট