চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

বন্ধু রজার পেনরোজের নোবেল জয়ে স্মৃতিতে ফিরলেন ড. জামাল নজরুল

তাসনীম হাসান

১৬ অক্টোবর, ২০২০ | ২:২২ অপরাহ্ণ

৩৪ বছর আগের কথা। প্রখ্যাত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের আহ্বানে আরেক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী স্যার রজার পেনরোজ তিনদিনের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে গিয়েছিলেন। মুছে যাওয়া সেই দিনগুলো ফের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পিছু ডাকছে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণী বলিষ্ঠকরণে কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কারের জন্য এবার অন্য দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে এই ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানীর নোবেল জয়ের খবরে।
এমনিতেই ছোট দেশের বড় বিজ্ঞানীখ্যাত জামাল নজরুল ইসলামের জন্য বুকের ভেতর এক টুকরো ভালোলাগার জায়গা বরাদ্দ দিয়ে রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। রজার পেনরোজের নোবেল জয়ের পর পুনরায় তাঁদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন প্রয়াত এই বিজ্ঞানী। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ছুঁয়ে যাওয়া এক বিজ্ঞানীর নোবেল জয়ে যেমন তাঁরা আবেগে ভাসছেন, তেমনি মনের ভেতর পুষে রাখা সেই চিরকালীন দুঃখটাও তাদের কাছে ফিরে এসেছে আবার-বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েও জামাল নজরুলের নোবেল না পাওয়া।
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা, এরপর গবেষণার কাজ করতে করতেই রজারের সঙ্গে জামাল নজরুল ইসলামের সখ্যতার সূত্রপাত। বয়সে রজার কিছুটা বড় হলেও বন্ধুত্বে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। বহু বছরের অভ্যস্ত উন্নত জীবন, লোভনীয় চাকরি ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ ছেড়ে ১৯৮৪ সালে দেশের টানে জামাল নজরুল ইসলাম চট্টগ্রামে ফিরে আসায় দুজনের দুটি পথ দু দিকে চলে গেলে তাতেও সম্পর্কে টান পড়েনি কখনো। দুই অভিন্ন আত্মার সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে কেবল জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে।
বন্ধু জামাল নজরুলের এক ডাকেই তাই ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে যোগ দিতে এসেছিলেন রজার পেনরোজসহ বিশ্বের নামকরা বিজ্ঞানীরা। ওই বছরের জানুয়ারির ৮ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা ভবনের পাশে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সেমিনার ভবনে (বর্তমানে পরিত্যক্ত) ‘ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ম্যাথমেটিক্স ফিজিক্স’ শিরোনামে এই সেমিনারের আয়োজন করেন জামাল নজরুল ইসলাম। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানজগতে যে জামাল নজরুল ইসলামের বেশ সমাদর ছিল তা বোঝা যায় সেই সেমিনারের অতিথিদের তালিকা দেখলে। রজার তো ছিলেনই। পাকিস্তানের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম থেকে জাপানের হুজোহিরো আরাকি, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জে সি টেইলর-দুনীয়াকাঁপানো সব বিজ্ঞানীকে যেন একই ছাদের নিচে হাজির করেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম।
সেই সেমিনারের পুরো দৃশ্যটা এখনো ভীষণভাবে উজ্জ্বল তখনকার তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক কামরুল ইসলামের স্মৃতিতে। ১৯৮৬ সালের সেমিনারের সেই তিনদিনে ফিরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের এই অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক পূর্বকোণকে বলেন, ‘কখনো আবদুস সালাম, কখনো রজার পেনরোজ আমাদের চোখের সামনেই তাদের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করছেন। বিষয়টি ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়। আমি সেমিনারের ফাঁকে ফাঁকে একটি ডায়েরিতে প্রখ্যাত এই বিজ্ঞানীদের অটোগ্রাফ নিয়ে রেখেছিলাম। পাশাপাশি এই বিজ্ঞানীরা দুই-এক লাইনের মন্তব্যও লিখে দিয়েছিলেন। আফসোস-বহু বছর ধরে আগলে রাখা সেই ডায়েরিটা হারিয়ে ফেলেছি।’
এ তো গেল সেমিনারের কথা। ২০০৬ সালে যখন-জামাল নজরুল ইসলামকে ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত করার প্রস্তাব আসল-তখন তাঁর জন্য সুপারিশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন রজার পেনরোজ। পাশাপাশি একই বিষয়ে জামাল নজরুলের হাতে গড়া ‘গণিত ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণাগারের’ তখনকার প্রধান অধ্যাপক এম এ মনসুর চৌধুরীর কাছেও হাতে লেখা একটি চিঠি পাঠান।
দুই বিজ্ঞানীর সম্পর্কের গভীরতা আঁচ করা যায় সেই চিঠিদ্বয়ে। রজারের প্রতিটি শব্দে যেন উঠে আসে জামাল নজরুলের জ্ঞান-গরিমার সনদ। উপাচার্যকে পাঠানো চিঠিতে তিনি লেখেন-‘একজন উচ্চতর বিজ্ঞানী ও অসাধারণ গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসাবে আমি জামাল নজরুলকে চিনি। তিনি বাংলাদেশে এক উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক কাজের প্রচারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই আমি তাঁকে ইমেরিটাস অধ্যাপক নিয়োগের প্রস্তাবটিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করছি।’ রজারের সেই চিঠির পর আর কীভাবে না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ? আমৃত্যু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম।
চিঠির কারণ ব্যাখ্যা করলেন বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম এ মনসুর চৌধুরী। গত বুধবার সন্ধ্যা নামার মুখে চন্দনপুরার বাসায় বসে পূর্বকোণের সামনে তিনি জামাল নজরুল ও রজার পেনরোজকে নিয়ে খুলে দিলেন স্মৃতির ঝাঁপি।
এম এ মনসুর চৌধুরী পূর্বকোণকে বলেন, ‘ইমেরিটাস অধ্যাপক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে ৩ জন বিদেশি ও ২ জন দেশের বিজ্ঞানী কিংবা পণ্ডিতের সুপারিশ দিতে হয়। রজার পেনরোজের পাশাপাশি বিজ্ঞানী জে সি টেইলর ও ফ্রিম্যান জে ডাইসন বিদেশি বিজ্ঞানী হিসাবে স্যারের জন্য সুপারিশ করেছিলেন।’
জামাল নজরুল আর রজার-দুজনকেই চাক্ষুস করা অধ্যাপক এম এ মনসুর চৌধুরী ও কামরুল ইসলাম পূর্বকোণকে জানান, দুজনেই ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে একই। আকাশসম মেধা-প্রজ্ঞার অধিকারী হলেও জামাল নজরুল ইসলাম বাস করতেন মাটির কাছাকাছি। অসুস্থতা ছাড়া কোনোদিনই দুষ্প্রাপ্য ছিলেন না তিনি। কোনো স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী থেকে সংগঠনের সভা-সেমিনার; দাওয়াত পেলেই উপস্থিত হতেন তিনি। আর শ্রোতাদের রাঙিয়ে দিতেন মহাবিশ্বের নানা বিষয় নিয়ে সবিস্তার আলোচনার মধ্যে দিয়ে। তেমনি রজারও একই। ভদ্র আর নম্র তো বটেই। এর সঙ্গে এতবড় বিজ্ঞানী, কিন্তু শরীরের এক বিন্দুতেও যেন অহঙ্কারের লেশমাত্র নেই।
তাই জামাল নজরুলের নোবেল না পাওয়া নিয়ে এখনো হতাশা ঝরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে। তাদেরই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাহমান নাসির উদ্দিন নিজের ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশিত জামাল নজরুল স্যারের দ্য আলটিমেট অব দ্যা ইউনিভার্স বইটি আজ সারাবিশ্বে পাঠ্য। স্যারের অনেক বন্ধু ও জুনিয়র নোবেল পেয়েছেন, কিন্তু স্যার পাননি। এ কষ্ট আমার কোনোদিন যাবে না।’
শুধু রাহমান নাসির উদ্দিন নন প্রতিবছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল ঘোষণার পরে অন্য শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে ভিড় করে আসে একটাই কথা। সেই কথার সারসংক্ষেপ হলো-পাশ্চাত্যে পড়ে থাকলে হয়তো-৭ বছর ধরে গরীবুল্লাহ শাহ (রহ.)-এর মাজারসংলগ্ন কবরস্থানের মাটির নিচে শুইয়ে থাকা প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর নামের আগেও উচ্চারিত হতো আরও দুটো শব্দ-‘নোবেল লরিয়েট!’ তাঁদের আফসোসটা যেন আরও দীর্ঘ করে দিলেন রজার পেনরোজ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট