চট্টগ্রাম শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪

সর্বশেষ:

তরমুজের রাজ্যে টমেটো বিপ্লব

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৬ অক্টোবর, ২০২০ | ২:১০ অপরাহ্ণ

‘তরমুজ ভালা পতেঙ্গার’-পতেঙ্গা এলাকায় উৎপাদিত সুস্বাদু তরমুজ নিয়ে এই গানের পঙক্তি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু বদলে গেছে চাষাবাদের ধরণ। তরমুজের রাজ্য এখন দখল করে নিয়েছে টমেটো। ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে হচ্ছে টমেটোসহ সবজি চাষ।
সরেজমিন দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের কূলঘেঁষে বয়ে গেছে আউটার রিং রোড। শহর রক্ষা বাঁধ হিসেবে পরিচিত ছিল এটি। রিং রোডের গা ঘেঁষে থরো থরোভাবে বিশাল এলাকাজুড়ে শোভা পাচ্ছে সবজি চাষাবাদ। বিশেষ করে টমেটোর চাষ বেশি করা হয়। রংপুর এলাকার চাষি এমদাদুল হক ২০ বছর ধরে এখানে চাষাবাদ করে আসছেন। তার সঙ্গে কথা হয় উত্তর-মধ্যম হালিশহর এলাকায়। তিনি বলেন, সবজি মৌসুম শুরু হওয়ার আগে চলে আসেন। এবার ভাতিজা সম্পর্কিত নাজমুল হোসেনকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন।
এমদাদুল হক বলেন, এখানে এক সময় প্রচুর পরিমাণ তরমুজ, বাঙ্গির চাষাবাদ করা হতো। এর সঙ্গে ছিল লাউ। অন্যান্য সবজির তেমন চাষ ছিল না। এখন তরমুজ ও বাঙ্গির চাষাবাদ নেই বললেই চলে। ভালো ফলন না হওয়ায় তরমুজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন চাষিরা। তবে কেউ কেউ শখ করে সামান্য আকারে তরমুজ চাষ করেন।
পাশে হালিশহর ফইল্যাতলী এলাকায় কথা হয় কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। রাজশাহী জেলার কামাল উদ্দিন ১৫ বছর ধরে এখানে চাষাবাদ করে আসছেন। তিনি বলেন, চার কানি জমিতে টমেটোর চাষ করেছেন। শীত ঘনিয়ে আসলে টমেটো ক্ষেতের সঙ্গে ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, শিম লাগানো হয়। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অন্য সবজি থেকে এখানে টমেটোর ফলন ভালো হয়। বাজারে দাম পেলে এক কানিতে তিন থেকে চার লাখ টাকা লাভ হয়। তাই কৃষকেরা টমেটো চাষাবাদে বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
কৃষকের হিসাব মতে, এক কানি জমিতে ৪-৫ হাজার চারা রোপণ করা যায়। চারা রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা ও টমেটো উত্তোলন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ টাকা খরচ পড়ে। প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে ৫ লাখ টাকার বেশি টমেটো বিক্রি করা যায়।
পতেঙ্গার খেজুরতলা, ইপিজেড, হালিশহর, কাট্টলী, সাগরিকায় নানা ধরনের সবজির চাষ করা হয়। পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় সবজি চাষ হয়। সাগরপাড়ে আউটার রিংরোড দিয়ে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত গেলে চোখে পড়ে একপাশে সাগর, আর সারি সারি জাহাজ। আরেক পাশে সুউচ্চ ভবন, নানা স্থাপনা আর জমি দেখা যায় নানা ধরনের সবজি ক্ষেতের।
মধ্যম হালিশহর এলাকায় দেখা যায়, কোনো এলাকায় আউশ ধান কাটা হচ্ছে। ধান কেটে সবজির জন্য জমি প্রস্তুত করা হচ্ছে। কোথাও সবজি চারা রোপণ ও কোথাও চারা পরিচর্যা বা চারার সঙ্গে বাঁশের কঞ্চি লাগিয়ে দিচ্ছেন। দেওয়া হচ্ছে কীটনাশক।
সবজি ক্ষেতে সার ও কীটনাশক ব্যবহারের বিষয়ে কৃষক এমদাদুল হক বলেন, কোন সময়ে জমিতে কি ধরনের সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় তা বুঝেন তারা। সবজি ও পোকার ধরন বুঝে সার প্রয়োগ করেন।
স্থানীয়রা জানান, ‘৯১ এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর তরমুজের চাষাবাদ কমে আসে। অধিক লাভজনক হওয়ায় লোকজন সবজি চাষে বেশি ঝুঁকেছেন। তবে উপকূলীয় এই এলাকায় দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। গড়ে ওঠছে সুউচ্চ অট্টালিকা আর শিল্প কারখানা।
মধ্যম হালিশহর এলাকার মো. হানিফ বলেন, এখানে বে-টার্মিনাল, বন্দর, কন্টেইনার ডিপো, বড় বড় কারখানা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। জমির পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। তারপরও খালি জায়গায় হচ্ছে ধান ও নানা ধরনের সবজির চাষাবাদ। ধানের চেয়ে সবজিতে লাভ বেশি হওয়ায় সবজি চাষের প্রসারতা বাড়ছে। কৃষকেরা জানান, ১ আশ্বিন থেকে সবজির চাষাবাদ শুরু হয়। দু-আড়াই মাস পর সবজি বাজারে তোলার উপযোগী হয়। তিন মাসের মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট সবজি বাজারে বিক্রি করা হয়।
এখানে শীত ও গ্রীষ্মকালীন-দুই মৌসুমেই সবজি চাষ করা হয়। গ্রীষ্মকালীন সবজির চেয়ে শীতকালীন সবজির চাষ বেশি হয়। এখানে মূলা, বেগুন, টমেটো, শিম, বেগুন, মিষ্টি কুমড়া, শালগম, ফুলকপি, বাঁধাকপি থেকে শুরু করে কাঁচা মরিচ, ধনেপাতাসহ সব ধরনের সবজি চাষ করা হয়। এখানকার উৎপাদিত সবজি নগরীর সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করছে।
কৃষি অধিদপ্তর জানায়, ‘১৪-১৫ মৌসুমে পতেঙ্গা ও ডবলমুরিং থানা এলাকায় গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করা হয়েছিল ৩২০ হেক্টর জমিতে। ‘১৭-১৮ মৌসুমে পতেঙ্গায় শীতকালীন সবজি ৮৪৭ হেক্টর ও ডবলমুরিং এ ২৯৯ হেক্টর জমিতে।
তবে স্থানীয় চাষিদের দাবি, পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার এলাকায় অন্তত ৩-৪ হাজার একর জমিতে সবজি চাষাবাদ করা হয়। এরসঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অন্তত ১০-১২ হাজার কৃষক।
কৃষি বিভাগ জানায়, ‘৯০ এর দশকেও পতেঙ্গা তরমুজের জন্য বিখ্যাত ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ও এক জমিতে দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের ফসলের চাষাবাদ হয়ে আসলে তা সাসটেইন করে না। এছাড়াও উপকূলীয় এলাকা লবণাক্ত সহনশীলতাও একটি বড় ফ্যাক্টর।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট