মানুষের মনের ভাব প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হল ভাষা, কিন্তু ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশেরর মধ্যে আবদ্ধ নেই। বর্তমানে সকল কর্মকান্ডের অন্যতম চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে ভাষা। যোগাযোগের মাধ্যম থেকে ভাষা পরিণত হয়েছে অর্থনীতির হাতিয়ারে। জাতির মেধা মননের সাথে ভাষা একটি প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীতে প্রায় ছয় হাজারের বেশী ভাষা প্রচলিত থাকলেও মানুষ কেবল বহুল প্রচলিত ভাষার সাথে পরিচিত। বহুল প্রচলিত ভাষার মধ্যে আরবি একটি ব্যাপক সমাদৃত ও বহুল প্রচলিত ভাষা, যা জান্নাতের ভাষা হিসেবে পরিচিত। মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয়, সংস্কৃতির বাহন হিসেবে আরবি ভাষা অর্জন করেছে ব্যাপক সমাদর। প্রতিটি মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতির সাথে আরবির বিচরণ যেন অপরিহার্য, ইবাদতের ভাষা হওয়ায় আরবি মুসলমানদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে জড়িত।
এ ভাষায় নাযিল হয়েছে আসমানী কিতাব ‘আল- কুরআন’, শেষ নবী মুহাম্মদ (স.) এর ভাষা আরবি হওয়াতে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, কারণ কুর’আন ও হাদীসে নববীর কারণে মুসলিম জাতির নিকট আরবি হল আত্মার স্পন্দন। আরবি ‘সেমিটিক’ ভাষা গোষ্ঠীর অন্যতম একটি ভাষা যা জীবন্ত ভাষা হিসেবে পরিচিত,এ ভাষার সাথে সর্ম্পকিত ভাষা হল হিব্রু ও আ্যারামিক সহ অবশিষ্ট ভাষাসমূহের বর্তমনে তেমন কোন জৌলুস নেই। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভাষা হিসেবে আরবি আজ বিশ্ব মঞ্চে একটি জনপ্রিয় ভাষা। ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে আরবি আজ সমগ্র বিশ্বের একটি পরিচিত ভাষাতে রূপান্তরিত পরিণত হয়েছে। প্রায় ৪২০ মিলিয়নের বেশী লোক এ ভাষাতে কথা বলে, পৃথিবীর ২২টি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হল আরবি। স্বনামধন্য গবেষকগণ মনে করেন আরবি হল সকল ভাষার মূল ভাষা। মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা হওয়ার প্রেক্ষিতে আরবি মুসলমানদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার্য।
এ ভাষা মুসলমানদের ধর্মীয়-অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি ব্যাপক স্থান দখল করে আছে। ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য হিসেবে মুয়াল্লাকা, মাকামার মত সাহিত্যের আবহে আরবী যেন ইউরোপীয় জ্ঞানের দরজায়ও করাগাত করেছে। ইউরোপ, আমেরিকা, ফ্রান্স, চীন ও ভারতে ও আরবির চাহিদা যেন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর। এসব দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ গুরত্ব সহকারে আরবি ভাষার চর্চা করে যাচ্ছে সাহিত্যের রস আস্বাদন সহ। ইতোমধ্যে আরবি লাভ করেছে খ্যতিমান আন্তর্জাতিক সংস্থা তথা জাতিসংঘ, ওআইসি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সহ অগণিত সংস্থার অফিসিয়াল ভাষার মর্যাদা। আরব রাষ্ট্রসমূহে আরবি ভাষার স্থান একচ্ছত্র, বিশাল ধনাঢ্য আরব সাম্রাজ্য যেন ভাষাগত দিক থেকে কেবল আরবির উপর নির্ভরশীল। একই ভাবে কুরআন ও হাদীস শাস্ত্রের ভাষা হওয়াতে ইসলামী সভ্যতা আরবী ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে থাকে ফলে অর্থনেতিক দিক থেকে ও আরবি ভাষা এক বিশাল স্থান দখল করেছে।
এ ক্ষেত্রে আরবী ভাষা রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনৈতিক কারণে বিশ্বে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আরবি ভাষাকে জাতিসংঘের অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ২০১০ সাল থেকে ইউনেস্কো ‘বহু ভাষার বিকাশ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে’ তরান্বিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ব আরবি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এতে আরবি ভাষার গুরুত্ব বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে। বিশ্বরাজনীতির প্রাণকেন্দ্র হল মধ্যপ্রাচ্য আর বর্তমান পৃথিবীর অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি তেলবাজারের একক কর্তৃত্ব আরবদের হাতে। বৈশ্বিক পরিমন্ডলে আরবি ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধির কারণে অনারব দেশসমূহ ব্যাপকভাবে আরব অর্থনীতির সুবিধা পাওয়ার জন্য নিজদেশে আরবি চর্চা করে যাচ্ছে। ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় আরবি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে অত্যন্ত কার্যকরভাবে এমনকি আরবি ভাষা সাহিত্যের উপর প্রদান করেছে পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রি।
ভারত কাশ্মীর ইস্যু মোকাবিলার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে নিযুক্ত কূটনৈতিকদের দিয়ে থাকে বিশেষ ভাষাগত প্রশিক্ষণ। অন্যদিকে বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন নিজ দেশের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে চর্চা করে আরবি ভাষা ও সাহিত্য। তারাও আরবির উপর প্রদান করছে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পিএইচডি ও পোস্ট-ডক্টরেট ডিগ্রি পযন্ত, উদ্দেশ্য আরব দুনিয়ার শক্তিশালী অর্থনীতির সাথে নিজেকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রেখে বাণিজ্যসহ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা আদায় করা। আর ইউরোপ, আমেরিকার ও ফ্রান্স বহু পূর্ব থেকে আরবিকে নিজের করে নেয়েছে আরও ব্যাপকভাবে। মুসলমানরা যখন স্পেন শাসন করতো তখন থেকে ফ্রান্স, ইটালীসহ ইউরোপের পাদ্রীগণ আরবি ভাষাসহ নানামুখী জ্ঞান অর্জন করতো। পরবর্তীতে নিজদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ব্যাপকভাবে আরবি ও প্রাচ্যভাষা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন শুরু করে, এবং ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামক একটি বিশেষ একটি পরিভাষার ও প্রচলন হয়।
এ সকল কিছুর মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও অর্থনীতির সুফল ভোগকরা। আমেরিকার খ্যাতনামা প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় আরবি ভাষা ও সাহিত্যকে গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দিচ্ছে নিজ দেশের শিক্ষার্থীদের, এ ক্ষেত্রে ব্যাপক অধ্যয়ন দক্ষতার জন্য তথা রাজনীতি,অর্থনীতি ও ক‚টনীতিতে শিক্ষার্থীদের পারদর্শী করার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে ‘মিডল ইস্টার্ন ইনিষ্টিটিউট’ ‘আফ্রিকান ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ’সহ নানা প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমাবিশ্ব সাধারণত বৈশ্বিক রাজনীতিকে ব্যাপক গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করে থাকে ও নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তাই আরবি ভাষাকে তারা ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, কূটনীতিতে প্রবাদ আছে মধ্যপ্রাচ্য হল বিশ্বরাজনীতির কিংমেকার। একটি ভাষাকে কেন্দ্র করে সমগ্র পৃথিবীর ব্যাপক আয়োজন সে গুরুত্বকে অর্থবহ করে তোলে। প্রমাণিত হয় বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজ সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে আরবি ভাষার ব্যাপক গুরুত্ব।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আরবি ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাপক, বিশাল জনগোষ্ঠীর ধর্ম পালনের বাহন হল আরবি ভাষা- যেমন কুরআন তেলাওয়াত, সালাত আদায়সহ দৈনন্দিন ইবাদত বন্দেগী পালনে আরবি ভাষার ব্যবহার একচ্ছত্র, আমাদের আরবি চর্চাও এখানে সীমাবদ্ধ তাও খুব মানসম্মত নয়। কিন্তু অর্থনৈতিক ও কূটনেতিক বিবেচনায় বাংলাদেশে আরবি ভাষা এখনও আশানুরূপ পর্যায়ে উত্তীর্ণ হতে পারে নি। সরকারি ভাবে কোন আরবি একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এখন ও বাংলাদেশ থেকে আরবি ভাষায় কোন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়না। দেশের প্রথম সারির হাতেগুনা কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগ থাকলেও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আরবি বিভাগ শূন্য। শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে’ আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ বিদ্যামান, অথচ, আরব বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নানাকারণে অত্যন্ত গভীর, বিশেষত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ হিসেবেও বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্ক কূটনীতির ভাষায় ‘অতি ঘনিষ্ট’।
বাংলাদেশের একটি বিশাল শ্রমবাজার হল মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আরবদেশসমূহ। সৌদি আরবে, ২৭ থেকে ৩০ লক্ষাধিক বাংলাদেশী প্রবাসী কর্মরত আছে, সৌদি শ্রমবাজারের ৩০ শতাংশ হল বাংলাদেশী শ্রমিক। কুয়েত,আরব আমিরাত, বাহরাইন, কাতারসহ আরবদেশে প্রায় এক কোটির উপর প্রবাসী বাংলাদেশী রেমিটেন্স আহরণ করছে। কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের আহরিত রেমিটেন্সের হার কম। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশের দশজন শ্রমিককের আয় ভারতীয় একজন দক্ষ শ্রমিকের সমান। কারণ আমাদের অদক্ষ শ্রমিক বেশী তা ভাষাগত হোক বা টেকনিক্যাল জ্ঞানের দিক দিয়ে হোক। আরব শ্রমবাজার সবসময় অদক্ষ শ্রমিকের উপর নির্ভর করেবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সেবাশ্রম থেকে সৃজনশীল ও পেশানির্ভর শ্রমবাজারের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। ডাক্তারী, প্রকৌশল,শিক্ষা, বাণিজ্য, নার্স,টেকনো ও ধর্মীয়-অর্থনীতির দিকে নজর দিতে হবে।
এ জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় (সাধারণ ও মাদ্রাসা) আধুনিক পদ্ধতিতে আরবি শিখন-শেখানো ব্যবস্থার সংযোজন করতে হবে, ভাষার মান ও ঐক্যতান ধরে রাখার জন্য বাংলা একাডেমির আদলে একটি আরবি একাডেমি প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। ‘ব্যবহারিক আরবি কোস’, ‘বাণিজ্যিক আরবি কোর্স’, নামে আরবি ভাষা ডিপ্লোমা কোর্সও স্বল্পসময়ে আরবি ভাষা শিখতে সহায়ক হবে। কূটনৈতিক তৎপরতা মাধ্যমে ‘আশ-শারকুল আওসাত’ আরবি পত্রিকাটি ঢাকা থেকে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে পারলে আরবি দৈনিক পত্রিকার অভাব পূরণ সম্ভব। এ আরবি পত্রিকাটি আরব বিশ্বের একটি খ্যাতনামা পত্রিকা যা লন্ডন থেকে মূল পত্রিকা প্রকাশিত হলেও বিশ্বের প্রায় ১৬ টি শহর থেকে প্রকাশিত হয়।
আরবি ভাষার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ বাংলাদেশের ধর্মীয় আবহ, সমাজ সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও কূটনীতিকে শক্তিশালী করবে। আমাদের চর্চা করতে হবে আরবি ভাষা ও আরববিশ্বকে সমানভাবে, যা আমাদের অর্থনীতি জন্য আর্শীবাদ বয়ে আনবে। আরবি আমাদের ধর্মীয় ভাষা হওয়ায় আমাদের ধর্মীয়-অর্থনীতেও এ ভাষার প্রভাব ব্যাপক।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, বিসিএস ক্যাডার, বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ, ঢাকা।
পূর্বকোণ/ইব