চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

সর্বশেষ:

নির্বাচনই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মৌলিক ঐতিহ্য

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

২ জানুয়ারি, ২০২৫ | ১:৫৭ অপরাহ্ণ

ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষিত হয়েছে। রাজনৈতিক দলসমূহের নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রস্তুতির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেছে। জনকল্যাণে সকল ধরনের অসংযত আচার-আচরণ, জনগণকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, দখল-চাঁদাবাজি সংহার করে নেতৃবৃন্দ দলকে সুসংহত করার সতর্কবার্তা দিয়েছেন। জনগণ অধির আগ্রহে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করার প্রতীক্ষায় রয়েছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান অনুযায়ী সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবাধ-সুষ্ঠু এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক যৌক্তিক ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ। নির্বাচন কমিশন যথার্থ দক্ষতা-যোগ্যতা-নিরপেক্ষতার সক্ষমতায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে এটিই কাম্য।

 

কমিশনের শক্তিমানতাই নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্যতম নিয়ামক। সরকার প্রধান বা অন্যকোন সংস্থা নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে রুটিন দায়িত্ব ব্যতীত নীতিগত কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ-বাস্তবায়ন কাঙ্খিত নয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই যথাযথ আইনি কাঠামোয় নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং জনপ্রতিনিধি নির্বাচন-সরকার গঠন একটি স্বাভাবিক পরিক্রমা। জনগণের সমর্থনের উপর পূর্ণাঙ্গ আস্থার ভিত্তিতে ঘোষিত রায়ে ফলাফল গ্রহণ এবং তদানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান প্রতিটি নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্য। সভ্যসমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠনের সকল কর্মকৌশল অবশ্যই পালনীয়। মূলত প্রাগ্রসর সমাজের দৃষ্টান্ত হিসেবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেকোন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ নির্বাচন কমিশনের উপর বর্তায়।

 

যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দেশের আপামর জনসাধারণের আশা আকাক্সক্ষাকার প্রতিফলন ঘটিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের অবারিত সাফল্য। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যথার্থ ধারণ ও পরিচর্যা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্যতম উপাদান। আপামর জনগণের সামষ্টিক চিন্তা-চেতনার উপস্থাপনে বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়ায় অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাই প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারার প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। মূলতঃ সকল দল-মতের সম্মিলিত অংশগ্রহণ-সমর্থনে নেতৃত্ব বাছাই এবং সঠিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে সরকার গঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। গণতন্ত্র হলো আধুনিক বিশ্বের সর্বাপেক্ষা সমাদৃত শাসনব্যবস্থা যা বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিশ্বের সর্বত্রই সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল।

 

বিপুল পরিবর্তন-পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানেও গণতন্ত্র সমধিক জনপ্রিয় শাসন ব্যবস্থার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। গণতন্ত্র যেকোন সমাজে পরিশুদ্ধ পন্থায় সমগ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে রাষ্ট্র বা সরকার পদ্ধতিকে নির্দেশিত করে। একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে জনগণের শাসন বা শাসন নীতির ইচ্ছানুসারে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাবলীল ধারণা-ধারাবাহিকতার সুস্পষ্ট বহির্প্রকাশ। গণতন্ত্র সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ, মানুষের স্বাধীনতা-অধিকার নিশ্চিতকরণ, রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাসহ সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যিক সৌকর্যের তাৎপর্যপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে সর্বজনস্বীকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠান। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশপ্রেমিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রস্তুতি সত্ত্বেও যেকোন সময় সহিংসতা-নাশকতা ঘটার সন্দেহে জনমনে ভীতি সঞ্চারণ অমূলক নয়।

 

উজ্জীবিত কর্মীদের উদ্দেশ্যে দলীয় নেতাদের উত্তেজক বক্তৃতা-বিবৃতিতে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। সকল প্রকার হুমকি-ধমকি এবং সংযত আচরণ বহির্ভূত অন্য কোন বিরোধ-বিচ্ছেদ পন্থা কোনোভাবে কাম্য হতে পারে না। বিরাজিত দেশীয় এবং বৈশ্বিক পর্যুদস্ত অর্থনৈতিক সংকটে যেকোনো দলের অস্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা জনগণ সহজেই অনুধাবন করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনীতির সব পক্ষকেই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন, মহান স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায় থেকে অদ্যাবধি অনেক দল-সরকার ও পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, রাষ্ট্র শাসনে দলসমূহ যথার্থ অর্থে আদর্শিক ঐতিহ্য তৈরি করতে পারেনি।

 

জাতীয় আদর্শের প্রকৃত ভিত রচনাতেও কতটুকু সার্থক ছিল তা পর্যালোচনার দাবী রাখে। গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। বহিঃ ও অন্তঃ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের যাঁতাকলে কঠিন নিষ্পেষিত ছিল এতদ অঞ্চলের মানুষ ও মানুষের জীবনপ্রবাহ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রচন্ড অবহেলার শিকারে নিপতিত ছিল এই পূর্বাঞ্চল। দেশ বিভাগের পর থেকেই বিশেষ করে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রজ্জ্বলিত হয় বাঙালির স্বজাত্যবোধের মহিমান্বিত স্ফুলিঙ্গ। স্বাধীকারের দীর্ঘ সংগ্রাম বাঙালিকে স্বাধীন সত্ত্বার জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বিপুল প্রাণ বিসর্জন ও অজস্র জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন মাতৃভূমি। প্রায় এক কোটি মানুষের শরণার্থীর জীবনযাপনের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা কখনো ভুলবার নয়।

 

প্রতি মুহূর্তে হায়েনাদের আক্রমণ ও প্রাণহানির আর্তনাদ নিয়ে দেশে থাকা মানুষের আহাজারিতে দেশের বাতাস ছিল অসম্ভব ভারি। এত বিসর্জনের পরেও অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার প্রচেষ্টা কেন ব্যর্থতার কালোমেঘে ঢাকা পড়ল তারও বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে এর ভাঙ্গনের মূলে যে কারণগুলো বিদ্যমান ছিল তা হচ্ছে প্রধানত গণতন্ত্র বিবর্জিত কেন্দ্রীয় একদেশদর্শী শাসন ব্যবস্থা ও পূর্ব বাংলার প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ, এর ভাষার প্রতি অগণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং সর্বোপরি শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশকে রুদ্ধ করার অপচেষ্টা। পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায় , ১৯৬১ সালের জরিপ অনুযায়ী এ অঞ্চলে জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ, এ অঞ্চলে রপ্তানি আয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের বিপরীতে ৫০-৭০ শতাংশ। আমদানী ব্যয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৫০-৭০ শতাংশের বিপরীতে ২৫-৩০ শতাংশ।

 

বেসামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ৮০-৮৪ শতাংশের বিপরীতে ১৬-২০ শতাংশ। সামরিক চাকুরীর ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের বিপরীতে ১০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পুঁজি বিনিয়োগ ২.১ শতাংশের বিপরীতে ০.৬ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে মঞ্জুরী ও আর্থিক সাহায্যের ক্ষেত্রে ১০.২ শতাংশের বিপরীতে ১.৪ শতাংশ। বৈদেশিক সাহায্য বিতরণের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ৭০-৮০ শতাংশের বিপরীতে ২০-৩০ শতাংশ। শিক্ষা অনুদানের ক্ষেত্রে ১.৫ শতাংশের বিপরীতে ০.২ শতাংশ। সামরিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে ৪.৭ শতাংশের বিপরীতে ০.১ শতাংশ। ১ম ও ২য় পাঁচশলা পরিকল্পনায় অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ৬৮ শতাংশের বিপরীতে ৩২ শতাংশ, ৩য় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ৬৮ শতাংশের বিপরীতে ৩৬ শতাংশ। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪১৯ টাকার বিপরীতে ১৯৬৫-৬৬ সালে ছিল ২৮৫ টাকা এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৭৩ টাকার বিপরীতে ২৯১ টাকা।

 

১৯৪৯-৫০ সালে প্রাদেশিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে পূর্ব অঞ্চলে ছিল ১২৩৭.৪ কোটি টাকা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল তা ১২০৯.১ কোটি টাকা যা ১৯৬৯-৭০ সালে গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২২৭১.৩ কোটি এবং ৩১৫৬.৩ কোটি টাকায়। একই সময় মাথাপিছু উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেটি ছিল পূর্ব পাকিস্তানে ২৯৩ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ৩৪২ কোটি তা গিয়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩২১ এবং ৫৪৬ কোটি টাকায়। ১৯৫০-৭০ দুই দশকে ৬৫০ কোটি বিদেশী ঋণের বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানে খরচ করা হয় ১৯৪.২ কোটি ডলার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪৫৫.৮ কোটি ডলার। তুলনামূলক বিশ্লেষণে এটি সুস্পষ্ট যে, কীভাবে আর্থ সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে এ জাতিকে নিষ্পেষিত করা হয়েছিল। শোষণ-শাসনে বাঙালিদের বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে সর্বত্রই রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হয়। একমাত্র ঐক্যবদ্ধতার শক্তিই জাতিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মত চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সাহস যুগিয়েছে।

 

নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাঙালির সচেতনতা-প্রতিবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের শক্তি পুঞ্জিভূত হয়। ক্ষোভের মাত্রা অপরিমেয় পর্যায়ে পৌছে গেলে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বাঙালির চেতনাবোধ নবতর অধ্যায় রচনা করে। সার্বিক ফলশ্রুতিতে সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রচলিত প্রবাদ হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা বহুগুণ বেশি কঠিন। বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশের আপামর জনগণ ও দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীসহ সকলেই ঐক্যবদ্ধ। যেকোন মূল্যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জুলাই ২৪ এর শহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

 

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী।

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট