চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

কেমন হওয়া উচিত ৮ বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ | ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ

ক্যান্সার যে কোন বয়সে হতে পারে তবে বয়স ৬০ এর পর ক্যান্সার হওয়ার শংকা অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই ৮ টি বিভাগীয় শহরে ১৮০০ কোটি টাকার বাজেটে ১০০ বেডের ক্যান্সার হাসপাতালের নির্মাণ কাজ চলছে।

কিছুদিন আগে বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের দুর্নীতি চিত্র গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কোটি কোটি টাকার যন্ত্র কেনা হয়েছে, অথচ প্রয়োজনীয় লোকবলই নিয়োগ হয়নি। আবার অযোগ্য লোক নিয়োগের কারণে প্রতিষ্ঠানটির কোন কার্যক্রম চালু হচ্ছে না। যার কারণে নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো।

 

আমরা সকলেই জানি- ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং জটিলতম। ভারত, ব্যাংকক অথবা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা আরো বেশি ব্যয়বহুল এবং ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা এবং বয়সজনিত কারণে অনেকের পক্ষেই বিদেশে যাওয়া সম্ভব হয় না। সুতরাং প্রস্তাবিত ৮ টি বিভাগীয় হাসপাতালে যাতে শুরুতেই দুর্নীতির শিকার না হয় সেই ব্যাপারে সচেতন জনগণ হিসাবে আমাদের সতর্ক থাকা এবং এই কার্যক্রমে ওয়াচডগ হিসাবে প্রতিটি বিভাগ তথা জনগণের সম্পৃক্ত থাকা উচিত।

 

৮ বিভাগীয় হাসপাতাল কিভাবে নির্মাণ হচ্ছে, লোকবল কতজন নিয়োগ হচ্ছে কি কি ক্যাপিটাল ইক্যুইপমেন্ট কেনা হচ্ছে, এটি জানার অধিকার নাগরিক হিসাবে আমাদের আছে।

 

ক্যান্সার চিকিৎসা একটি মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিমের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। এই টিমে সাধারণত ডাক্তার হিসাবে থাকেন রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, যিনি রেডিয়েশনের সাহায্যে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। বর্তমানে ৬০ ভাগ ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহৃত হয়।

 

মেডিকেল অনকোলজিস্ট কেমোথেরাপি, ইমুনোথেরাপি অথবা টার্গেটেড থেরাপির সাহায্যে চিকিৎসা করে থাকেন। কেমোথেরাপি মূলত ইনজেকশন অথবা টেবলেট হিসাবে রোগীকে দেওয়া হয়। সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট, অপারেশনের মাধ্যমে ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। গাইনীকোলজিক্যাল অনকোলজিস্ট সার্জারির মাধ্যমে নারীর রিপ্রোডাকটিভ সিস্টেমের ক্যান্সারের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। ডাক্তার ছাড়াও সহযোগী চিকিৎসক কর্মী যেমন মেডিকেল ফিজিসিস্ট, অনকোলজি নার্স, রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট এবং আরো অনেক এল্যাইড হেলথ ওয়ার্কার ক্যান্সার চিকিৎসার টিমের সদস্য হিসাবে কাজ করে থাকেন। এছাড়াও রেডিওলজি বিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া আধুনিক ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্ভব হয় না। বর্তমানে আধুনিক ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিয়েশন ডেলিভারি দেওয়া হয় লিনিয়ার এক্সিলারেটর (লিনেক) মেশিনের মাধ্যমে। বিশ্বব্যাপী মূলত দুটি কোম্পানি এই মেশিনগুলো তৈরি করে থাকে। একটি আমেরিকান কোম্পানি অন্যটি ইউরোপিয়ান কোম্পানি। মেশিনের মডেল অনুযায়ী একটি মেশিনের আনুমানিক মূল্য ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকা। আমেরিকান কোম্পানিটির নাম ভেরিয়ান এবং ইউরোপিয়ান কোম্পানিটির নাম ইলেক্ট্রা। ব্যাপারটা অনেকটাই বোয়িং এবং এয়ারবাস কোম্পানির মতই।

 

আধুনিক লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন একটি জায়ান্ট কম্পিউটারের সাথে থাকে অনবোর্ড কোণবীম সিটিস্ক্যান, যা দিয়ে রিয়েল টাইম সিটিস্ক্যানও করা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি হাসপাতালে কার্যকর লিনিয়ার এক্সিলারেটর মেশিন ৪ থেকে ৫ টির বেশি নেই। চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতালে ২টি মেশিন আছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের লোক সংখ্যা অনুপাতে এ মেশিন দরকার কমপক্ষে ২০০ টি। ভারতে খওঘঅঈ আছে ৭০০ টির বেশি।

 

LINAC ছাড়াও একটি আধুনিক ক্যান্সার সেন্টার এ সিটি সিমুল্যাটর মেশিন, ব্রাকি থেরাপি মেশিন, পিইটি স্ক্যান, সিটি স্ক্যান ও এমআরই মেশিন থাকা জরুরি। চট্টগ্রাম এ সিটি সিমুলেটর আছে একটি।

 

LINAC মেশিন একটি অত্যন্ত হাই প্রিসিশন রেডিয়েশন ডেলিভারি মেশিন। এটার মুভমেন্ট সাবমিলিমিটার লেভেল এ ডিটেক্ট করা যায়। যার কারণে হাইলি কোয়ালিফাইড মেডিকেল ফিজিসিস্ট এবং কোম্পানি সার্টিফাইড আইটি ইঞ্জিনিয়ার অন সাইটে সবসময় থাকতে হয়। রেডিয়েশন যেহেতু খালি চোখে দেখা যায় না তাই এই মেশিনগুলোর রেডিয়েশন ডেলিভারির কার্যকারিতার জন্য সঠিক কোয়ালিটি এসুরেন্স শতভাগ নিশ্চিত করতে হয়। এই দায়িত্ব পালন করেন মেডিকেল ফিজিসিস্ট। উনারা প্রতিটি মেশিনের দৈনিক এবং সাপ্তাহিক কোয়ালিটি এসুরেন্স নিশ্চিত করেন যার ফলে রোগীরা সঠিক প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী রেডিয়েশন পেয়ে থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় মেডিকেল ফিজিসিস্টের সংখ্যা অনেক কম।

 

কোবাল্ট-৬০ নামে রেডিয়েশন মেশিন ১৯৫১ সালে কানাডায় আবিষ্কার হয়, এই মেশিন ক্যান্সার চিকিৎসায় যুগান্তকারী সময়ের সূচনা করে।

 

তারপর গেম চেঞ্জার হিসাবে আসে খওঘঅঈ, ১৯৬২ সাল থেকেই খওঘঅঈ এর নতুন নতুন মডেল অনকোলজি কম্যুনিটি ব্যবহার করছেন। ইতিমধ্যে CBALT-60 মেশিনের ব্যবহার কমতে শুরু করে।

 

বর্তমানে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক এবং ভারতের নামকরা কোন সেন্টারই কোবাল্ট -৬০ মেশিন ব্যবহার করে না।
শোনা যাচ্ছে ৮টি বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল এ কোবাল্ট-৬০ মেশিনও কেনা হবে।

 

কোবাল্ট-৬০ মেশিনের সুবিধা হলো কম মেইনটেইনেন্স খরচ, ইন্ফ্রাস্ট্রাকচার রিকোয়ারমেন্ট কম, বৈদ্যুতিক পাওয়ার কম লাগে, বীম প্যারামিটারের কোয়ালিটি এসুরেন্স অত জটিল নয়।

 

আমি মনে করি আমাদের কোবাল্ট-৬০ মেশিনের যুগে ফিরে যাওয়ার কোন যুক্তি নেই। তবে প্যালিয়েটিভ রেডিয়েশন দিয়ে ব্যথা কমানোর জন্য কোবাল্ট -৬০ মেশিনের ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি কোবাল্ট -৬০ এর সাহায্যে রেডিয়েশন দিতে অত বেশি টেকনিক্যাল নলেজ দরকার হয় না এবং সহজে রেডিয়েশন দেওয়া যায়। তবে এই মেশিন কেনার ব্যাপারেও সরাসরি মাদার কোম্পানি থেকে কেনা উত্তম।

 

পৃথিবীর প্রায় দেশ সরাসরি ভেরিয়ান অথবা ইলেক্ট্রা (LINAC তৈরির কোম্পানি) থেকেই মেশিন কিনে থাকে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকার লোকাল সাপ্লাইয়ার এর কাছ থেকে কিনেন। যার ফলে মাদার কোম্পানির কোন দায়বদ্ধতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে থাকে না। আমি মনে করি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ক্রয়নীতি পরিবর্তন করা দরকার। যেহেতু লিনাক, সিটিসিমুলেটর, সিটি স্ক্যান, এম আরআই ও পিইটি স্ক্যান মেশিন অত্যন্ত দামি এবং হাইলি টেকনোলজি ডিপেন্ডেন্ট, তাই এই মেশিনগুলো সরাসরি মাদার কোম্পানি থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কেনা উচিত। গত ৫০ বৎসর ধরে এই সব মেশিনগুলো লোকাল সাপ্লাইয়ারের মাধ্যমে কেনার ফলে সরকার তথা জনগণের টাকার যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না এবং রোগীরা প্রকৃত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরাসরি মাদার কোম্পানির সাথে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে কিনলে মেশিন সার্ভিসিং, পার্টস সরবরাহ এ লেবার সাশ্রয়ী মূল্যে করার সম্ভাবনা বেশি এবং মাদার কোম্পানির নিজস্ব ইঞ্জিনিয়ার মেশিনের যে কোন ট্রাবল শুট সহজে সমাধান করতে সক্ষম হবেন। এখানে একটি ব্যাপার উল্লেখ না করলেই নয়। এমিরাটস এয়ার লাইনে বোয়িং নির্মিত বিমান এর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় বোয়িং কোম্পানি তাদের সবচেয়ে বড় পার্টস সেন্টারটি রেখেছে দুবাইতে। যার ফলে এমিরাটসের বিমানের জন্য যেকোন পার্টস দ্রæত সময়ে সরবরাহ করতে পারে। সেই কারণে বাংলাদেশ যদি একটি কোম্পানি থেকে রেডিয়েশন মেশিনগুলো কিনে তাহলে সেই কোম্পানি ঢাকাতে ওদের সার্ভিস সেন্টারও খুলতে পারে।

 

সরকারি নিয়ম অনুয়ায়ী প্রস্তাবিত ৮ টি বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণের জন্য একজন প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন, যার দায়িত্ব হল যথাযথভাবে হাসপাতালের ভবন নির্মাণের দেখভাল করা এবং প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল ইক্যুইপম্যান্ট সংগ্রহ করে স্থাপন করা। তবে লোকবল এর নিয়োগ কিভাবে হবে আমার জানা নেই। প্রকল্পে প্রস্তাবিত লোকবলের একটি ব্যাপার আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি। যেমন মেডিকেল শুধু ক্যান্সার বিভাগে অফিসারের পোস্ট রাখা হয়েছে সর্বমোট ৭৭৬টি এবং কনসালটেন্ট পোস্ট রাখা হয়েছে ২৪০টি, স্পেশালাইজড হাসপাতালে মূলত সকল চিকিৎসার দায়ভার কনসালটেন্টদের এবং তাদের সহযোগী হিসাবে কাজে সহযোগিতা করে থাকেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকরা। মেডিকেল অফিসারের ভূমিকা খুবই সীমিত। সুতরাং মেডিকেল অফিসার সংখ্যা হওয়া দরকার নূন্যতম (প্রতিটি হাসপাতালে ১০ জনের বেশি মেডিকেল অফিসারের পদ রাখা অথবা থাকা উচিত হবে না)। এছাড়াও আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেডিকেল অফিসারের পোস্টগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যবহার করা হয় এবং এদের কোন দায়বদ্ধতা না থাকায় এরা চাকরিবিধি যথাযথভাবে মানতেও চান না। বিএসএমএমইউ এর কনসালটেন্টরা এ ব্যাপারে ভালো মতামত দিতে পারবেন বলে আমার ধারণা।

এছাড়াও প্রয়োজনীয় লোকবল বিশেষ করে রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, মেডিকেল ফিজিসিস্ট, রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট, ডসিমেট্রিস্ট (বর্তমানে আমাদের দেশে এই পেশার কোন লোক নেই), অনকোলজি নার্সদেরকে স্বল্প মেয়াদী (৩-৬ মাস) এর বিশেষ কোর্স করানো প্রয়োজন। এসব কোর্স সেই সমস্ত সেন্টারে করানো উচিত যেখানে একই মডেলের (যেই মডেল বাংলাদেশ কিনবে) খওঘঅঈ এর সাহায্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই লোকবলের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আগেভাগে না করলে মেশিনগুলো ব্যবহার করা যাবে না।

 

আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই ধরনের প্রকল্প যখন শুধুমাত্র একজন প্রজেক্ট ডাইরেক্টর করেন তখন প্রায় সময় কোন জবাবদিহিতা থাকে না। আমাদের দেশে অনেক সিনিয়র অনকোলজিস্ট আছেন যারা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আমার মতে ৮ টি বিভাগীয় ক্যান্সার হাসপাতাল এর জন্য ৮ টি ‘ক্যান্সার হাসপাতাল ওয়াচডগ কমিটি অথবা নাগরিক অধিকার কমিটি’ সিনিয়র অনকোলজিস্টরা গঠন করতে পারেন। ওয়াচডগ কমিটিতে ৫ থেকে ১০ জন বিভিন্ন পেশাজীবী যেমন আইনজীবী, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সমাজসেবক এবং ধর্মীয় নেতারা থাকবেন। এই কমিটি প্রতিমাসে অন্তত একবার প্রজেক্ট ডাইরেক্টরের সাথে মিটিং করে প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানবেন। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে সিনিয়র অনকোলজিস্টদের এগিয়ে আসা উচিত। আমরা যদি সবাই আগে থেকেই সতর্ক না হই তাহলে ৬০ বৎসর বয়সে নিজে অথবা পরিবারের কেউ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে সঠিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবে অথবা বেশি টাকা দিয়ে প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে সেবা নিতে হবে। বিদেশে বেড়াতে যাওয়া খুবই আনন্দের কিন্ত বিদেশে চিকিৎসাজনিত কারণে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য।

সেজন্য বিদেশে চিকিৎসাজনিত শারীরিক ও মানসিক কষ্ট এবং অর্থনৈতিক কষ্ট এড়াতে হলে নিজ দেশেই বিশ্বমানের চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

আমরা যেমন একটি সুন্দর জীবন সবাই কাটাতে চাই তেমনিভাবে একটি সুন্দর মৃত্যুও সবার কাম্য।

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ডালহাউসি ইউনিভার্সিটি, সেইন্টজন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউ ব্রান্সউইক, কানাডা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট