মহালয়ার মধ্য দিয়ে শারদীয় দুর্গাপূজার আগমন ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনালগ্ন আজ। ঢাকের তালে বেজে উঠেছে দেবীর আগমন ধ্বনি। মন্দিরে মণ্ডপে চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে আয়োজন।
বুধবার (২ অক্টোবর) ভোর থেকেই মন্দিরে সমবেত হয়ে প্রার্থনা করেন ভক্তরা। সাধারণত মহালয়ার ছয় দিন পরই হয় দেবী দুর্গার বোধন। অর্থাৎ মহালয়ার পর থেকে দেবীর আগমনের ঘণ্টা বাজে। পঞ্জিকা অনুযায়ী এবার দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন দোলায় চেপে, ফিরবেন গজের (হাতি) পিঠে চড়ে। পিতৃপক্ষের অবসান এবং দেবীপক্ষের সূচনায় শুরু হয় মহালয়ার ক্ষণ। দেবী দুর্গা যে আসবেন– তা জানান দেয় মহালয়া।
দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হলো শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। দুর্গোৎসবের তিনটি পর্ব– মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। মহালয়ায় দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা হয় শুরু।
মহালয়া ‘ শব্দটির অর্থ- মহান যে আলয় বা আশ্রয়। ‘মহালয়া’ শব্দটিকে স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ এই দিনেই পিতৃপক্ষের অবসান হয় এবং অমাবস্যার অন্ধকার দূর হয়ে আলোকময় দেবীপক্ষের শুভারম্ভ হয়। এখানে দেবী দুর্গাই হলেন সেই মহান আলয় বা আশ্রয় ।
ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য । আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে শারদীয় পূজা ও দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।
সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষদের জন্য, সঙ্গে পুরো জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, অঞ্জলি প্রদান করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এদিনে এমনই করেছিলেন।
সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্মাদের মর্ত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাহাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। পিতৃপক্ষের (অমাবস্যা) শেষদিন এটি এবং দেবীপক্ষের (পূর্ণিমা) সূচনা।
পিতৃলোককে স্মরণের অনুষ্ঠানই মহালয়া। এমনটিও বলা হয়ে থাকে যে, পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি – তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার ‘ বার্তা বহন করে আনে। এ ক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্ন টির নাম মহালয়া। মহালয়ার মধ্য দিয়েই দেবীর মর্ত্যে আগমনের সূচনা ঘটে। বিশেষ পূজা আর মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খের ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবীকে আবাহন করা হয়।
মহালয়ার সঙ্গে অবসান হয় কৃষ্ণপক্ষের। এর পর সূচনা হয় দেবীপক্ষের। এরপর শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত নয়টি রাত্রিতে দুর্গার নয়টি রূপের পূজা চলে। এই নয়টি রূপের নাম হল- শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মান্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী।
বুধবার মহালয়ার দিনে ভোর থেকে পূজামণ্ডপগুলোতে চণ্ডীপাঠ, পূজা অর্চনা আর ঢাকের বোলে দুর্গাদেবীকে আহ্বান করা হচ্ছে। মহালয়া উপলক্ষে আজ জাতীয় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজা অর্চনা ও অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। কল্পারম্ভ আবাহনে বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্বালন, ঘট স্থাপন, চণ্ডীপাঠ, পূজা অর্চনা, আরাধনা, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে স্মৃতি তর্পণ ও ধর্মীয় সংগীত অনুষ্ঠিত হবে। মহালয়ার পরে শুরু হবে পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা।
ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বুধবার ভোর ৬টায় ঢাকের বোলে চণ্ডি পাঠে শুরু হয় মহালয়ার পর্ব। আগমনী গানের মাধ্যমে শুরু হয় আড়ম্বরপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় ‘দেবী দূর্গার মহিষাসুর বধ’ দেখানো হয়। এরপর ভক্তদের মাঝে প্রসাদ বিতরণ হয়।
ঢাকেশ্বরীতে মহালয়ার দ্বিতীয় পর্বের মূল আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ১০টায়। এই পর্বে ভক্তরা পূর্ব পুরুষের আত্মার শান্তি কামনায় তিল তর্পণ করেন। পরে মহালয়ার ঘট স্থাপন ও বিশেষ পূজা হবে।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্যমতে, এবার সারাদেশে ৩২ হাজারের বেশি স্থায়ী ও অস্থায়ী মণ্ডপে দুর্গাপূজা হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরে পূজা হবে ২৫৩টি মণ্ডপে। ইতোমধ্যে দুর্গোৎসবের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। পূজামণ্ডপগুলোতে প্রতিমা নির্মাণ, প্যান্ডেল স্থাপনসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম আরও আগেই শুরু হয়েছে।
পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ৯ অক্টোবর মহাষষ্ঠী তিথিতে হবে বোধন, দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা। পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে সেদিন। পরদিন ১০ অক্টোবর সপ্তমী পূজার মাধ্যমে শুরু হবে দুর্গোৎসবের মূল আচার। অষ্টমী ও নবমী শেষে ১৩ অক্টোবর বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসবের।
পূর্বকোণ/পিআর