বৃক্ষ কেবল নিসর্গ প্রকৃতির শোভা নয়। তা মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। বৃক্ষহীন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায়না। মানুষের বসবাসের উপযোগী ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীর জন্য দরকার গাছপালা। গাছপালা কেবল অক্সিজেন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করে তা নয় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বৃক্ষ আবহাওয়া মন্ডলকে বিশুদ্ধ রাখে, জলীয়বাষ্প তৈরি করে বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে বায়ুমন্ডলকে রাখে শীতল। বৃক্ষ বৃষ্টি ঝরিয়ে ভূমিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি করে। বাড়িয়ে দেয় মাটির জল ধারণের ক্ষমতা। এ ছাড়া গাছপালা ও মাটির উর্বরতা বাড়ায়। মাটির ক্ষয় রোধ করে। ঝড়, ঝআঞআ বন্যা খরা রোধেও পালন করে সহায়ক ভূমিকা। মাটির উপর শীতল ছায়া বিছিয়ে ঠেকায় মরুকরণের প্রক্রিয়াকে। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বনায়ন বৃদ্ধি করা উচিত। তা না হলে আমরা গ্রীন হাউস এফেক্ট এর করাল গ্রাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবো না।
অক্সিজেন আমরা পেয়ে থাকি গাছপালা থেকে। বাংলাদেশের মানুষের যে পরিমাণ অক্সিজেন দরকার সে পরিমাণ অক্সিজেন মেটানোর মতো বনভূমি আমাদের দেশে নেই। ভারসাম্য মূলক প্রাকৃতিক জন্য দেশের মোট ভূমির অন্তত ২৫% শতাংশ বনভূমি থাকা দরকার। তাছাড়া বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে শতকরা ২২% শতাংশ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- কোন মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপণ কিংবা কোন ফসল আবাদ করে, এরপর তা থেকে পাখি, মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু কিছু ভক্ষণ করে তবে তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (বুখারী ও মুসলিম শরীফ) এবং উহা থেকে যা চুরি হয়ে যায়, তাও তোমার পক্ষে একটি সদকা হিসেবে পরিগণিত হয়। (মুসলিম শরীফ) এ প্রসঙ্গে হযরত আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু এর একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, একদা হযরত আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু দামেস্কে একটি বৃক্ষ রোপন করছিলেন। এমন সময় একজন লোক তাঁর নিকট দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। লোকটি আবু দারদা রাদিআল্লাহু আনহু কে অত্যন্ত মনোনিবেশ সহকারে বৃক্ষ রোপন করতে দেখে একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিশ্বস্ত সাহাবি হওয়া সত্তে¡ও বৃক্ষ রোপণের এ কাজটি করছেন? হযরত আবু দারদা রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু উত্তরে বললেন, আপনি এমনটি বলবেন না। আমি খোদ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘কোন ব্যক্তি যদি বৃক্ষ চারা লাগায়, অতঃপর তা থেকে মানুষ কিংবা আল্লাহ পাকের যেকোনো সৃষ্টি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তখন তা রোপন কারির জন্য একটি সদকা হিসেবে পরিগণিত হয়।’ পবিত্র কুরআনে সূরা ইয়াসিন ৮০নং আয়াতে মহান আল্লাহ পাক বলেন- যিনি আল্লাহ তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ (শক্তি) আগুন উৎপাদন করে দিয়েছেন। সে মতে তোমরা তা হতে (নিজেদের) আগুন জ্বালিয়ে নিতে পার। সুরা বাসা ২৪-৩২ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। অতঃপর আমি ভূমি প্রকৃষ্টরুপে ভালোভাবে বিতারিত করি। এবং উহাতে আমি উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, যায়তুন, খেজুর বহু বৃক্ষ বিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদির খাদ্য। ইহা তোমাদের এবং তোমাদের পশুগুলো ভোগের জন্য। গাছ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাইতো বলা হয় যে, From cradle to coffin tree is necessary. বর্তমানে গাছপালা থেকে প্রায় ১০৯ হাজার রকমের দ্রব্যসামগ্রী প্রয়োজন হচ্ছে। যার অধিকাংশই আমরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছি। আজকের বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের যুগেও মানুষ তার শরীরের পরিধেয় সমস্ত বস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস, জুতা, চশমা সবকিছুই গাছ থেকে পেয়ে থাকে। গাছপালা শুধু মানব ও প্রাণিক‚লের খাদ্য হিসেবেই নয়। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এর রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিআল্লাহু তায়ালা আনহু ফলদায়ক বৃক্ষ কর্তন করা অথবা ধ্বংস করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং তার পরবর্তী মুসলমানগণ এর উপর আমল করেছেন।(তিরমিযি) প্রাকৃতিক পরিবেশকে মনোরম, সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখতে হলে আমাদের প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। গাছ বাঁচলেই আমরা সুন্দর ভাবে বাঁচার সুযোগ পাবো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় গাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। জ্বলোচ্ছ্বাস, আগুন, ভূমিধ্বস, বালিয়াড়ী, ঝড় রোধ ও নিয়মিত বৃষ্টিপাত ঘটাতে বৃক্ষের জুড়ি নেই। গ্রীষ্মকালের তীব্র তাপমাত্রা কমাতে এবং শীতকালে তাপমাত্রা বাড়াতে বৃক্ষের রয়েছে অপরিসীম ভূমিকা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যখন কিয়ামত সংঘটিত হবে তখনও যদি কারো হাতে চারা গাছ থাকে তাহলে সে তা রোপন করে- (আহমদ হাদিস নং ১২৫১১২)। অন্য হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেছেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার কবরে সাত ধরনের কাজের পূণ্য সওয়াব পৌঁছতে থাকবে, তন্মধ্যে একটি হলো বৃক্ষ রোপন। (যাকি উদ্দিন আল মানযির, আততারগীব ৫ম খন্ড)। একটি দেশের কমপক্ষে ২৫% শতাংশ এলাকা জুড়ে বনের প্রয়োজন। বাংলাদেশে এক সময় ৪০% শতাংশ এলাকা জুড়ে বনভূমি ছিল। বর্তমানে বৃক্ষ আচ্ছাদিত বন এলাকা ১০% শতাংশ মাত্র। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যেভাবে বন উজাড় ও বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, সে অনুপাতে বৃক্ষ রোপন ও বনায়ন সৃষ্টি হচ্ছেনা। প্রতিবছর ৮০০০ আট হাজার হেক্টর বনভূমি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ‘বৃক্ষ রোপণ অভিযান’কে সরকারি বেসরকারি ও বিভিন্ন সংস্থা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে যেভাবে পালন করা হয়। সেভাবে বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে সোচ্চার কিংবা সচেতন হতে দেখা যায়না। তাছাড়া বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে সরকারি আইনের কঠোর প্রয়োগের অভাব। আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বৃক্ষ রোপন অভিযান পালন তা কখনো লক্ষ্য পূরণে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ও নতুন বনায়ন সৃষ্টি হবে না। বৃক্ষ রোপনকে উন্নয়নের অংশ মনে করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের আরো জোরালোভাবে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি বৃক্ষ রোপণ ও নতুন বনায়ন সৃষ্টি করতে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাস্তা কিংবা সড়ক লেইন উন্নয়ন অথবা নির্মাণের দুধারে বৃক্ষ রোপণ বাধ্যতামূলক করা উচিত। বাংলাদেশে ৩৫০ জন সংসদ সদস্য জনপ্রতিনিধি রয়েছে। প্রতিবছর উন্নয়নের অংশ হিসেবে একজন এমপির অধীনে এক লক্ষ চারা রোপণের উদ্যোগ নিলে বছরে তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ চারা রোপন হবে। দশ বছরে ৩৫ কোটি চারা রোপণ হবে। তবে হবে লক্ষ্য পূরণ। এ দায়িত্ব নিতে হবে এখন থেকেই। এতে নির্মাণ হবে আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ্য, সুন্দর ও নির্মল পরিবেশে। বাস্তবায়ন হবে ‘গাছ লাগিয়ে যতœ করি, সুস্থ্য প্রজন্মের দেশ গড়ি’। শ্লোগান। তাই বৃক্ষ রোপনের মাধ্যমে মানুষ যেমন পার্থিব ও অফুরন্ত সুযোগ পেয়ে থাকে। তেমনি রয়েছে পরকালীন মুক্তি ও কল্যাণ লাভের সুযোগ।
পূর্বকোণ/এসএ