[হুসাম জোমলট গত ১০ নভেম্বর, ২০২৩-এ বিখ্যাত মার্কিন টিভি প্রোগ্রাম ফ্রন্টলাইন-এ দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বন্দ্বের খুঁটিনাটি নিয়ে। ‘সময়ের দাবি’ বিবেচনায় তথ্যবহুল এ সাক্ষাৎকারের উল্লেখযোগ্য অংশ দৈনিক পূর্বকোণের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হচ্ছে (প্রশ্ন ও উত্তর আকারে)। আজ শেষ পর্ব।]
ট্রাম্প প্রশাসনের সময়েই কি হামাসের ক্ষমতায়ন হয়েছিল? আপনি স্পষ্টতই ‘হতাশা’র কথা বলেছেন। আমরা জানি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং পিএলও সর্বোত্তম চেষ্টা করেছে অহিংস উপায়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সঠিক সমাধানে পৌঁছাতে। শেষ বিকল্প হিসেবেই কি হামাস ছিল, যারা ট্রাম্পের সময়কালে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল?
আমি মনে করি কেবল হামাস নয়, চলমান অহিংস পন্থার ব্যর্থতার সুযোগে ভবিষ্যতে আরো অনেক প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর দেখা পাব আমরা।
ভবিষ্যতে মানুষ যখন কোনো আশার আলো আর দেখবে না, সম্ভাবনার দ্বারগুলো যখন একে একে বন্ধ হয়ে যেতে দেখবে তাদের চোখের সামনে, অভাব যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে- তখন তাদের সামনে আশার আলো হয়ে উদয় হবে অনেক ‘দল’। এদের অবশ্যি আলাদা এজেন্ডা থাকবে তবে লক্ষ্য থাকবে একটাই- জাতিকে রক্ষা করা এবং জাতির অধিকার সমুন্নত রাখা। এমনও দল থাকবে যারা নিজেরা কারাবরণ করে এসেও শত্রæকে জিম্মি করবে। নিজেরাই তারা জিম্মি, অনন্যোপায় হয়ে এ কাজে নামবে তারা। তারা কিন্তু হামাস নয়। প্রসঙ্গক্রমে একটি ভুল ধারণা ভেঙে দিই- হামাস নয়, জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ‘ফাতাহ’ই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সামনে এমন আরো অনেক দৃশ্য দেখা যাবে।
গাজায় আজ যা ঘটছে তা নেহাতই নজিরবিহীন মানবিক দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। ২৩ লাখ মানুষকে ইচ্ছাকৃত অনাহারে রাখা, ১০ লাখেরও বেশি লোককে স্থানান্তর ও গণ বিতাড়ন করা, নিজেদের বাড়িঘর ও আশ্রয়কেন্দ্রে (জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্রে) গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। মানুষ যেখানেই থাকুক সে মানুষ-ই তো! কেউ আছে আশ্বাসে ভরা, অনুপ্রেরণাতে ভরা, আশায় ভরা, সম্ভাবনা ও সুযোগে ভরা অবস্থায় অথবা কেউবা আছে হতাশা, ক্রোধ, অপমানবোধ, লক্ষ্যবস্তু, হত্যা বা গণহত্যার মিশ্র অনুভূতিতে ভরা অবস্থায়। আমি মনে করি এই পৃথিবীর প্রতিটি ফিলিস্তিনি, সে ফিলিস্তিনেই হোক বা প্রবাসী এবং নির্বাসিত হোক, এখন ২য় ধরনের অনুভূতিপূর্ণ অবস্থায়। তারা আজ মনে করছে যে,তাদের জীবন অন্যান্য জীবনের মতো আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়; তাদের জীবন একই মানের নয়; ফিলিস্তিনি শিশুরা অন্য সব শিশুদের মতো নয়। নইলে কেন আজ হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশুকে অকাতরে হত্যা করা হচ্ছে? কই আমরা আজওতো কোনোও মার্কিন মুখপাত্রকে প্রকাশ্যে বলতে শুনি না, “এটি অগ্রহণযোগ্য।” শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নয়, আমেরিকান মূল্যবোধ অনুযায়ীও-তো তারা এটা বলতে পারতেন! ফিলিস্তিনি জনগণ এতে দারুণভাবে আহত হয়েছে।
৭ অক্টোবর হামাস যা করেছে, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব কী দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন?
আমি আপনাকে বলেছি যে আমরা ৩০ বছর ধরে অহিংসা এবং আলোচনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে। আর একটা সত্য হল যে, ৭ অক্টোবরের কয়েক ঘণ্টা পরে, ২২টি আরব রাষ্ট্র, আমার রাষ্ট্রপতি এবং আমার সরকারসহ কায়রোতে একটা সমাবেশ করেছিল এবং সেখানে ‘বেসামরিক মানুষকে টার্গেট’ করার নিন্দা করেছিল। এরপরও যখন পশ্চিমারা অমন প্রশ্ন করে তখন তাদের ‘নিয়ত’ নিয়েই প্রশ্ন উঠে।
আমরা নৃশংসতার কোনো ইসরায়েলি নিন্দা শুনিনি, এবং আপনি কখনই পশ্চিমে, আমেরিকায়, তারা নিজেদের নিন্দা করবেন বলে আশা করতে পারেন না।
তারও পর প্রশ্নটি ইঙ্গিত দেয় যে, আমরা আগ্রাসী, আমরা দখলকারী, আমরা আমাদের নিজেদের জমির উপনিবেশকারী। প্রশ্নটি উস্কে দেয় যে আমরাই সমস্ত সহিংসতার শুরু করি। আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে তাদের নৃশংসতার ভয়াবহ বিবরণ দেওয়া হলেও মিডিয়ায় তার ‘সাড়া’ মেলে সামান্যই। কিন্তু যখনই ইসরায়েলিদের আঘাত করা হয়েছে তখন আমার মতো কূটনীতিকদের ব্রিটিশ, আমেরিকান মিডিয়ার স্টুডিওগুলোয় নিয়ে আসা হয়েছে তা দেখার জন্য। আসলে তারা চায় যে, আমরা মেনে নিই যে ‘প্রকৃতপক্ষে ইসরায়েলি জীবন অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ’। এখানে বর্ণবাদ পুরো মাত্রায় কাজ করেছে। নইলে দেখুন- আমরা কি দেখি- একটি মূলধারার মিডিয়া ইসরায়েলি মুখপাত্রদের কাছে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে, “আপনি কি হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শিশুদের হত্যার নিন্দা করেন?” আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং সাংবাদিকরা, ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করছে, “ইসরায়েল এখন গাজায় যা করছে এবং তার আগে যা করেছে, তা কি সন্ত্রাসবাদ?”.. না। এর উত্তর হচ্ছে ‘না’। আসলে এখানে ‘ভারসাম্য’ বলতে কিছুই নেই। আইনের সমান প্রয়োগের বালাই নেই। লক্ষ্য যেন একটাই- বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে এই ধারণা দেওয়া যে, ফিলিস্তিনিরাই নিন্দিত। এরাই বরাবর সহিংসতার কাজ করছে। এর মানে কি তবে এটা দাঁড়ায় না যে, সুদীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে আমরা (ফিলিস্তিনিরা) সবচেয়ে ভয়ংকর, ইচ্ছাকৃত নিপীড়নের শিকার হয়ে চলেছি?
স্যার, আমি বুঝতে পারছি আপনি কি বলছেন। যদি আমার কাছে ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ হয়, তাহলে আমি তাদের একই রকম প্রশ্ন করব যা আপনি উত্থাপন করেছেন। আমি বরং এর থেকেও এগিয়ে যেতে চাই, কারণ আমরা আজকে ‘বাস্তব’ ও ‘সত্য’ সম্পর্কে কথা বলছি।
হ্যাঁ, সুযোগ হলে আপনি অবশ্যি সেটা করুন। কারণ গত বছরগুলোয় কেবল আলোচনাই হয়েছে। শান্তির কাছাকাছি যাবার কোনোও সুযোগকেও তারা আজ নষ্ট করে দিতে চাইছে। অনেক ‘ছাড়’ দেবার পর যে ‘দ্বি-রাষ্ট্র’ সমাধানে আমরা যেতে চাইছি তাতেও আজ সুস্পষ্ট বাধা দেখতে পাচ্ছি। কিছুতেই সেটা হতে দেয়া যায় না। হামাস ঠিক এ জায়গাটিকেই তাদের টার্গেট করেছে।
লেখক পরিচিতি
[হুসাম জোমলট বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনি মিশনের প্রধান। তিনি এর আগে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের স্ট্রাটেজিক অ্যাডভাইজার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি দূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি জাতিসংঘে একজন অর্থনীতিবিদ এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনৈতিক গবেষক হিসেবেও কাজ করেছেন।]