চট্টগ্রাম বুধবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : আবদুল অদুদ চৌধুরী

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

২৪ নভেম্বর, ২০২৩ | ৬:০৪ অপরাহ্ণ

ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে রাউজান উপজিলার নোয়াজিশপুর গ্রাম ছিল বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মতো একটি অজপাড়া গাঁ। যাতায়াতের জন্য ছিল না কোন রাস্তা এবং ছিল না কোন উচ্চবিদ্যালয়। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের সময়টা ইতিহাসে ছিল অনেক ঘটনা এবং অঘটনের সমাহারে মোড়ানো। এই সময়টাতেই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়। ব্রিটিশ শাসনামলের পরিসমাপ্তিও ঘটে এই সময়ের শেষদিকে। এই সময়টায় খুব সম্ভবত ১৯০৭ মতান্তরে ১৯০৮ সালে নোয়াজিষপুর গ্রামের ওয়ালী চৌধুরী বাড়ি প্রকাশ ওয়ালী বলি বাড়িতে আবদুল অদুদ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন।

অদুদ চৌধুরীর বাবার নাম ছিল হাজী ছৈয়দ আহাম্মদ চৌধুরী। তার পিতার নাম আবদুল কাদের চৌধুরী। তিনি তৎকালে জমিদার ছিলেন বলে কথিত আছে। অদুদ চৌধুরীর বাবা রেংগুনে ছিলেন বলে জানা যায়, তবে কি করতেন জানা নাই। তাঁর মায়ের নাম ছিল ওমদা খাতুন। তিনি ফোরক চৌধুরীর বড় বোন ছিলেন। তৎকালীন সময়ে ফোরক চৌধুরী নোয়াজিশপুরে ধনাঢ্য ব্যাক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন।জনাব অদুদ চৌধুরী ছোটবেলায় কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন নাই। তাই হয়তো শিক্ষার প্রতি উনার একটা আকর্ষণ ও ভালবাসা ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯১৮ সালে। স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধপরবর্তী অবস্থায় সারাদেশে অর্থনৈতিক মন্দা ও কাজের অভাবে লোকজন বিশেষ করে যুবসমাজ বিদেশে পাড়ি জমানো শুরু করেন। বর্তমানে আমাদের এলাকার লোকজন ভাগ্যান্বেষণে যেমন আরব আমিরাত, ওমান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমান ঠিক তখনকার দিনে যুবসমাজের বিদেশ বলতে ছিল বার্মার আকিয়াব ও রেংগুন শহর। সেই ধারাবাহিকতায় অদুদ চৌধুরী প্রথম রেংগুনে চলে যান। পরে ছোট ভাই রাজ্জাক চৌধুরী রেংগুনে বড় ভাই এর সাথে যোগ দেন। সেই সময় মানুষ জাহাজে করে রেংগুন যাওয়া আসা করতেন। ফটিকছড়ির দৌলতপুরের ধনাঢ্য ব্যাক্তি ছিলেন আবদুল বারী চৌধুরী, উনার ছিল সমুদ্রগামী প্যাসেঞ্জার জাহাজ, সেই জাহাজে লোকজন রেংগুন যাওয়া আসা করতেন। শিল্পপতি এ কে খান, আবদুল বারী সাহেবের মেয়েকে বিবাহ করেছিলেন। কথিত আছে, আবদুল বারী সাহেবের জাহাজে চট্টগ্রামের লোকজনের ভাডা দেওয়ার সামর্থ না থাকলে বিনা ভাড়ায়ও যেতে পারতেন। আগেই উল্লেখ করেছি অদুদ চৌধুরী উনার ছোট ভাই সহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জীবিকার তাগিদে রেংগুনে যাত্রা করেন। রেংগুন ছিল বার্মার রাজধানী এবং বাণিজ্যিক শহর। রেংগুন পোর্টে তৎকালীন সময়ে বড় বড় জাহাজ হ্যান্ডেলিং করার সুব্যাবস্থা ছিল। তাই রেংগুন ব্যবসা ও চাকুরীর জন্য তখনকার সময় ছিল একটি আকর্ষণীয় শহর। অদুদ চৌধুরী সাহেব খুব সম্ভবত সেখানে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছিলেন বলে জানা যায়।

১৯৩৯ সালে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রেংগুনে থাকাটা নিরাপদ ছিল না। বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবে অদুদ চৌধুরী ও তার ছোটভাই আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী দুজনই বার্মার রেংগুন শহরের ছোট ব্যবসা গুটিয়ে কোলকাতায় চলে আসেন। এদিকে ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হয়। দুই ভাই কোলকাতায় ভালই ব্যবসা-বাণিজ্য করছিল। কিন্তু বিধিবাম, কোলকাতায় ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে কোলকাতায় থাকা নিরাপদ ছিল না। তখন অদুদ চৌধুরী উনার ভাই সহ ফিরে আসেন জন্মস্থান প্রিয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামএ এসে ১৯৪৭ সালে চাক্তাই এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। আগেই বলেছি অদুদ চৌধুরীর বাবার নাম ছিলেন হাজী সৈয়দ আহমদ চৌধুরী। অদুদ চৌধুরী বিবাহ করেন ফোরক চৌধুরীর কন্যা আমাতুন নুর চৌধুরীকে। তৎকালে ফোরক চৌধুরী অনেক সহায় সম্পত্তির মালিক ছিলেন।

অদুদ চৌধুরী ব্যবসার পাশাপাশি প্রথমে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী ছিলেন। অদুদ চৌধুরীও দেশে আসার পর যেখানে ব্যবসা করেছেন সেখানেই একটি করে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। অদুদিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, হাটহাজারী অদুদিয়া মাদ্রাসা, চন্দ্রঘোনা অদুদিয়া মাদ্রাসা, কাপ্তাই ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারীর মেখলে মসজিদ, চাক্তাই ফোরকানিয়া মাদ্রাসা উনার ব্যাবসা কেন্দ্রের আশেপাশেই নির্মিত করেছিলেন। আজকালকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে এইভাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার প্রবণতা অনেকাংশে কম বলে মনে হয়। তখনকার সময় নোয়াজিষপুর ও চিকদাইর এলাকায় প্রাইমারী স্কুল ছিল হাতেগোনা কয়েকটি। চিকদাইরে ছিল ১৯০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ভৈরব সওদাগরের স্কুল (মধ্য সর্তা রাম সেবক এম, ই স্কুল)। নোয়াজিষপুরের প্রথম স্কুল ছিল ফতেনগর নতুনহাট ফ্রি প্রাইমারী স্কুল। খুব সম্ভবত ১৯১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় স্কুল ‘উত্তর ফতেহ নগর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল’ ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ফতেহ মোহাম্মদ সিকদার বাড়ির মাওলানা মোহাম্মদ ইদ্রিস সিকদার। উনি ছিলেন আরবী শিক্ষিত মাওলানা, কিন্তু সেই আমলে ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরে এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন। এই স্কুলটির অবস্থান ছিল বর্তমান ফতেহ মোহাম্মদ শিকদার বাড়ির একেবার উত্তর পাশে। জায়গাটি স্কুলভিটা নামে পরিচিত। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি জমি প্রদান, স্কুলের নির্মাণ ছাড়াও স্কুল পরিচালনার যাবতীয় ব্যায় বহনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

মোহাম্মদ ইদ্রিস সিকদার ১৯৩১ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত ‘উত্তর ফতেহ নগর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল’ এর সেক্রেটারি ছিলেন। সমসাময়িক সময়ে চাক্তাই এর ব্যাবসায় অদুদ চৌধুরী অনেক নগদ টাকার মালিক হন। ব্যাবসার সাথে সাথে উনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা শুরু করেছিলেন। আগেই উল্লেখ করেছি উনি চট্টগ্রামের চাক্তাই, হাটহাজারী ও চন্দ্রঘোনায় বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। সেই ধারাবাহিকতায় নিজ গ্রামেও নিজ ভিটার পাশে নির্মাণ করেন ফতেনগর অদুদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা। তখন চিকদাইর এবং নোয়াজিষপুর মিলে একটি ইউনিয়ন ছিল। অদুদ চৌধুরী এই ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট (এখন এই পদটি চেয়ারম্যান নামে পরিচিত) নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন নিজের গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। উনার এই কাজে এলাকার গণ্যমান্য অনেক ব্যাক্তি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সেই সময় চিকদাইর নোয়াজিষপুর এলাকায় কোন উচ্চবিদ্যালয় ছিল না। একমাত্র স্কুল উত্তর ফতেনগর ফ্রি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯৬৩ সনের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অস্থায়ীভাবে চলছিল অদুদ চৌধুরীর মাদ্রাসার পাশে। তখন একমাত্র হাই স্কুল ছিল রাউজান আর আর এ সি উচ্চবিদ্যালয়। আমার পিতা মোহাম্মদ ইসহাক সিকদার ১৯৪১ সালে এই স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেছিলেন।

অদুদ চৌধুরী এলাকার উন্নয়নে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য মনস্থির করেন ১৯৬১-৬২ সালের দিকে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন এবং স্কুলের জন্য একটা জায়গা উনি পছন্দ করেন, যা উনার বাড়ির সামনে এবং ফতেহ্ মোহাম্মদ সিকদার বাড়ি সংলগ্ন। প্রথমে প্রাইমারী স্কুলের ভবনের কাজ শুরু হয় এবং পরবর্তীতে উচ্চবিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ শেষ হয়। ১৯৬৫ সন থেকে ফতেনগর নোয়াজিষপুর অদুদিয়া উচচবিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। নোয়াজিষপুর রাঙ্গামাটি মহাসড়ক (গহিরা বাজারের মোড়) থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। কোন গাড়ি চলাচলের রাস্তা ছিল না। এলাকার লোকজন নৌকাযোগে অথবা পায়ে হেঁটে চলাচল করত। তখন অদুদ চৌধুরী একটি সড়ক নির্মাণ করার কথা চিন্তা করলেন। রাঙ্গামাটি সড়ক থেকে নোয়াজিষপুরের শেষ মাথা (তকির হাট) পর্যন্ত বিভিন্ন লোকজনের জায়গা কিনে রাস্তা করার জন্য ঘোষণা দেওয়া হল। কিছু জমি তখনকার বাজার দরে কিনতে পারলেন কিছু জমি বেশী দামেও কিনতে হল। জায়গা কিনার প্রসেসটা খুবই স্বচ্ছ ছিল বলে জানা যায়। কাউকে জোর করা অথবা ঠকানো হয়নি। জনাব ফজল মুন্সীকে সাথে নিয়ে আমীন সহ মাপজোক করে সাথে সাথে নগদ টাকা জমির মালিকদেরকে পরিশোধ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই ভাবে সম্পূর্ণ নিজের টাকায় এই সড়কটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৫ সালে। ফতেনগর অদুদিয়া উচ্চবিদ্যালয় ছাড়াও তিনি হাটহাজারীতে একটি মাদ্রাসা, নোয়াজিষপুর অদুদিয়া ফাজিল মাদ্রাসা, হাটহাজারী অদুদিয়া মাদ্রাসা, চন্দ্রঘোনা অদুদিয়া মাদ্রাসা, কাপ্তাই ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারীর মেখলে মসজিদ, চাক্তাই ফোরকানিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত করেন। একজন লোক নিজে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত না হয়েও পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষার কথা চিন্তা করে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত করায় বর্তমানে নোয়াজিষপুর ও আশেপাশের গ্রামের লোকজন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে ও বহির্বিশ্বে। ফতেনগর নোয়াজিষপুর অদুদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের সাথে সাথে অদুদিয়া রোড তৈরীর কাজও শেষ হয়। নোয়াজিষপুর আস্তে আস্তে একটি আলোকিত ইউনিয়নে পরিনত হয়।

১৯৭১ সনের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আহবানে শুরু হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। শহর থেকে অনেক পরিবার গ্রামে ফিরে আসে। চারিদিকে আতংকিত একটা সময়ের ভেতর মানুষের দিন কাটছিল। ঠিক এমন একটা সময়ে নভেম্বর মাসের ২৪ তারিখে হঠাৎ করে এই শিক্ষানুরাগী মানুষটি এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন। অদুদিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নের শুরু থেকেই ফতেহ মোহাম্মদ সিকদার বাড়ির অবদান ও যোগসূত্রের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই ধারাবাহিকতায় ফতেহ মোহাম্মদ সিকদার বাড়ির সুযোগ্য সন্তান বর্তমান নোয়াজিষপুর চেয়ারম্যান জনাব এম সরোয়ার্দী সিকদার ১৯৯৭ সাল থেকে এই স্কুলের পরিচালনা কমিটির বিভিন্ন পদে থেকে স্কুলের উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি। স্কুলের উন্নয়নের সাথে সাথে চেয়ারম্যান সরোয়ার্দী সিকদারের নিরলস প্রচেস্টায় প্রতিবছর নভেম্বর মাসে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অদুদ চৌধুরীর অবদানকে স্মরণ করার জন্য আয়োজন করা হয় দোয়া মাহফিল, আলোচনা অনুষ্ঠান ও চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবান। সকল নোয়াজিষপুরবাসী এবং প্রবাসী অনেক ভাইয়েরা সতস্ফুর্তভাবে এই বাৎসরিক অনুষ্ঠানে আর্থিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে থাকেন, কারণ অদুদ চৌধুরী উনার জনহিতকর কাজের মাধ্যমে আমাদের সকলের অন্তরে স্থান করে নিয়েছেন। তাই নোয়াজিষপুরবাসী উনার কাছে কৃতজ্ঞ। এই মহান মানুষটি এখন শুয়ে আছেন নোয়াজিষপুরে উনার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও স্কুলের পাশেই। নোয়াজিষপুরবাসী অদুদ চৌধুরীর অবদান কখনো ভুলে নাই এবং ভবিষ্যতেও ভুলবে না।

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট,
সেইন্ট জন রিজিওনাল হসপিটাল, নিউব্রুন্সউইক।
এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

শেয়ার করুন