চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

স্বর্ণালী বর্ণালী আলোর বিচ্ছুরক রিদোয়ান, আমরা কি তোমায় ভুলতে পারি?

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস

২৭ অক্টোবর, ২০২৩ | ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ

একই বিদ্যাপিঠের অনুজ সতীর্থ অধ্যাপক মো. রিদোয়ানুর রহমান। কালের কপোল তলে হারিয়ে গেলো। এত তাড়াতাড়ি। যা কল্পনার বাইরে। ভাবছি কীভাবে কী লিখব। কতকিছু আজ মনে আসছে। কয়েক যুগের বন্ধন। তবে সবার আগে যা মনে আসছে তা হলো ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের রাজার রাজত্বে’। রিদোয়ান আসলে তাই ছিল।
সিরিয়াস সেমিনার। প্রথম বক্তা রিদোয়ান। খবর নেই। টেলিফোন আমাকে। আপনি আগে দিয়ে দেন। আমি আসছি শেষে দেবো। তখনও সে প্রেজেন্টেশন রেডী করছে। যা তা নয় সবচেয়ে পেনেট্রেটিং প্রেজেন্টেশন। এমনি ভাবে সব কিছু অত্যন্ত ইজি ভাবে নেয়া তার অভ্যাস ছিল। না কোন চিন্তা, না কোন বিকার, না কোন হা হুতাশ। তবে সত্য প্রকাশে রিদোয়ান ছিল অনমনীয়। এতে সে অনেক ভুল বুঝাবুঝির শিকার হতো।
তার ছিল বিশাল হৃদয় এবং প্রয়োজনে নিজের ক্ষতি জেনেও সামষ্টিক কল্যাণে কখনও ঠিক থেকে চ্যুত না হওয়া। বিরল এ যুগে। বছরের পর বছর আমরা এক সাথে একটা রিসার্চ গ্রুপে কাজ করেছি। কিন্তু কোন কিছুর জন্য তাকে উদ্বিগ্ন হতে কখনও দেখিনি। আমেরিকান মেরিনের সবচেয়ে প্রচলিত শব্দ হলো ‘ডেমেজ কন্ট্রোল’। রিদোয়ান তাতে খুব পারঙ্গম ছিল। পরীবিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনার অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল। এবং তা সে ঈর্ষণীয়ভাবে জীবনভর প্রয়োগ করেছে। কিন্তু নিয়তির টান জীবনের শেষ সময়গুলোতে সেই ক্ষমতা হয়ত ফ্লপ করেছে।
অত্যন্ত মেধাবী ও স্মৃতি এবং ধীশক্তির অধিকারী। নিজের মত করে পড়াশুনা করে যেত রিদোয়ান অন্যের থেকে যা আলাদা, কিন্তু দিনশেষে ফলাফলে সবার শীর্ষে। এফসিপিএস পাশ করার পর বান্দরবানে পোস্টিং-এ কাজ করার সময় তার উপলব্ধিতে প্রথম আসে ফাস্টলাইন এন্টিমেলেরিয়াল ক্লোরোকুইনের অকার্যকারীতা। এর প্রেক্ষিতে তার গবেষণায় প্রমাণিত হয় ক্লোরোকুইন রেজিস্টেন্স। ৯০ দশকের সেই সময়ে প্রতিবছর মেলেরিয়ায় মৃত্যু ছিল হাজার হাজার। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পদায়িত হলে সমমনা আমরা ক’জন অধ্যাপক এম এ ফয়েজের নের্তৃত্বে মিলে হয় মেলেরিয়া রিসার্চ গ্রুপ। এই গ্রুপের গবেষণার সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি হতে পারে দেশ থেকে আজ মেলেরিয়া নির্মূল হতে যাচ্ছে এবং কোন মৃত্যু নেই। তাছাড়া এই গ্রুপ দেশে ডেঙ্গীর প্রাদুর্ভাবের উদঘাটন করেছে, দিয়েছে কালাজ¦র নিরাময়ের প্রায়োগিক ব্যবস্থাসমূহের নির্দেশনা। অনেক গাইডলাইন তৈরী হয়েছে এভিডেন্স বেইজড মেডিসিন অনুযায়ী। সবসময় সে বলত রেসিডিউয়াল নলেজ বাড়াতে হবে, যা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ আর চলার পাথেয়।
‘সাগর সঙ্গমে সাতার কেটেছি কতো হই নাই তো কখনও ক্লান্ত’। রিদোয়ানের জীবন যাপন ছিল তারই অনুরণন। একটার পর একটা নিত্য নতুন কিছু। তার কাছে শিখেছিলাম সবাই এক নয় টয়োটা ফেক্টরিতে উৎপাদিত গাড়ীর মত। সব কিছুই এক রকম মনে হলেও পার্থক্য আছে। আসলেই তাই। সবার সব বিভিন্নতাকে লসাগুর মতো করে নিলেই একসাথে কাজ করা যায়। একেক জনের একেক বৈপরিত্য মেনে নিয়ে জীবনের সমন্বয় করে। তাকে কখনও ক্লান্ত হতে দেখিনি। তাইতো জীবনের শেষ ক্লান্তিতে সে হারিয়ে গেলো কি যে এক অবলীলায়।
আমাদের পেশার তিনটা ডায়মেনশন আছে চিকিৎসা, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও গবেষণা। একটা গন্ডি। কিন্তু তার বাইরেও অন্য দিগন্ত আছে। আমরা সবাই হয়তো জানি না। যেমনি করে গেয়েছিলেন, ‘খিড়কী থেকে সিংহ দুয়ার, এই তোমাদের পৃথিবীর বাইরে জগত আছে তোমরা মান না’। রিদোয়ানের ছিল গ-ীর বাইরের এ বিরাট জগৎ। বন্ধু, সখ, বেড়ানো, নতুন অন্বেষণ, বিশ্লেষণ ও আরও কতকিছু। সবচেয়ে অবাক ছিল সে গ-ী আর দিগন্তকে সমন্বয় করতে পারতো অবলীলায়। যেমন গবেষণা-কার্যক্রমের সাথে বন্ধুদের সহ বেড়ানোর আড্ডাবাজী। ঠিক তেমনি অগ্রজ, সহপাঠী, সহকর্মী, শিক্ষার্থী, প্রশিক্ষণার্থী, রোগী, ছোট বড় সবার সাথে যথাযথ পেসে চলাচলের দুরহ কাজ তার পক্ষেই সম্ভব ছিল। হাসি হাসি মুখটাতে ঝিলিকমারা বুদ্ধিদীপ্ততা, স্নেহ বা সমীহের বা প্রশ্রয়ের চ্ছটা ছিল অনন্য বেশিষ্ট্য। তার সাথে কাজ-কর্মে অনেক কিছুতে একমত হয়েছি, আবার অনেক কিছুতে দ্বিমত, কিন্তু তা কখনও ফাটল হয়ে দেখা দেয়নি।
অধ্যাপক রিদোয়ানের মতো স্বর্ণালী বর্ণালী জীবন খুব বিরল। যেমন অনুভবে রিন রিন করে, যে জীবন দোয়েলের ফড়িংয়ের মানুষের সাথে তার কোন কালেই দেখা হয় না। অধ্যাপক রিদোয়ানের মতো হয়তো আর কোন অবয়বের সাথে দেখা হবে না। যে ছিল সুদুরেরও পিয়াসী হারিয়ে গেলো কোন সুদুরে। স্বর্ণালী বর্ণালী আলোর বিচ্ছুরক রিদোয়ান আমরা তোমায় কখনও ভুলব না।

অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস
সতীর্থ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও
সঙ্গী, মেলেরিয়া রিসার্চ গ্রুপ।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট