তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৮২১ কোটি টাকার বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা শনাক্তের পর বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, এটি পুরো ঘটনার ছোট একটি অংশ মাত্র। পাচারের আসল চিত্র আরও অনেক বড়। এ অর্থ পাচারের সঙ্গে অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির যোগসূত্রও তারা পেয়েছেন। এই ঘটনায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে। অর্থ পাচারের ঘটনাকে ‘টিপ অব দ্যা আইসবার্গ’ বা মূল ঘটনার ছোট একটি অংশ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থ পাচারের পুরো চিত্রটি কতো বড়?
যেভাবে শনাক্ত হলো রপ্তানির নামে অর্থ পাচার:
এই বছরের শুরুর দিকে রপ্তানির পর্যায়ে থাকা কয়েকটি পণ্যের চালান আটক করা হয়েছিল কাস্টমস হাউজে। তখন দেখা গেছে, টন টন পণ্য, ভালো কোয়ালিটির টিশার্ট, জ্যাকেট, প্যান্ট- এগুলো বাইরে গেলেও তার বিপরীতে কোন মূল্য দেশে আসছে না। কারণ বিক্রি করার সময় তারা এটাকে নমুনা বলছে।
সাধারণত তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রেতাদের কাছে পণ্যের নমুনা পাঠানো হয়, যাতে তারা ওই পণ্যটি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। এ ধরনের নমুনার পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা নয়। এজন্য জড়িত রপ্তানিকারক, যারা শুল্কায়নের সাথে জড়িত ছিলেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদপ্তর। এতে অর্থ পাচারের মামলা করা হবে।
অর্থ পাচারের চিত্র আসলে কত বড়?
অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করেন, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে টাকা বেরিয়ে যায় দুইভাবে – একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার, আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। এমনকি অনেক সময় খালি কন্টেইনার যাওয়া আসা করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
তবে শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তারা অভিনব একটি উপায় দেখতে পেয়েছেন। সেটা হলো ক্রেতাদের কাছে নমুনা হিসাবে পণ্য পাঠানোর কথা বলা হলেও আসলে তার মাধ্যমে টন টন পণ্য পাঠানো হয়েছে, যার কোন মূল্য দেশে আসেনি।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত পরিদপ্তর তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সব মিলিয়ে পাচার করা অর্থের পরিমাণ ৮২১ কোটি টাকার বেশি। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত এভাবে বিদেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে।
এই সময়ে মোট ১৩ হাজার ৮১৭টি চালানের মাধ্যমে ৯১২১ টন পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কাতার, সৌদি আরব। এসব পণ্যের মূল্য ৯৩৩ কোটি টাকা হলেও দেশে এসেছে মাত্র ১১১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৮২১ কোটি টাকাই পাচার হয়ে গেছে। বছরে বাংলাদেশ থেকে আশি হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বলে বলছে গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। বাণিজ্যের মাধ্যমে কারসাজি করে অর্থ পাচারের তালিকায় বিশ্বের ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম রয়েছে।
তৈরি পোশাক খাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙ্গুল:
তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত। ফলে এই খাতের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফলে এসব খাতের রপ্তানি পণ্যে দ্রুত ছাড় দেয়া হয়, কড়কড়িও কম করা হয়। এরই সুযোগ নিয়েছে এই অপরাধী চক্রটি।
শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা শামসুল আরেফিন খানও বলছেন, সাধারণভাবে রপ্তানি করা পণ্যকে একটু বিশেষ চোখে দেখা হয় এবং প্রায়োরিটি ভিত্তিতে শুল্কায়ন করা হয়। কিন্তু যখন সেটা আন্ডারভ্যালু করা হয়, তখন দেশের ক্ষতি, কারণ দেশের সম্পদ গেলেও তার বিনিময়ে কিছু আসছে না। আর এখানে এমন উপায় নেয়া হয়েছে, যে দেশে কিছুই আসেনি।
জিএফআই প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থ বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে পায় সেটির প্রায় তিনগুণ টাকা পাচার হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তা এবং আইনজীবীরা বলছেন, টাকা পাচার হয়ে গেলে সেটি আবার দেশের ভেতরে ফিরিয়ে আনা বেশ কঠিন কাজ।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আমি মনে করি, যে ব্যবসা করবে, সে ওভার ইনভয়েসিং বা আন্ডার ইনভয়েসিং করে খুব বেশি ব্যবসা করতে পারেন না। তবে কেউ যদি এ ধরনের অপরাধ করে থাকে, গোয়েন্দাদের তদন্তে সেটা বেরিয়ে আসে, তাহলে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত, যাতে অন্যরা এ থেকে শিক্ষা পায়।
বছরের পর বছর ধরে অর্থ পাচারের অভিযোগ:
বাংলাদেশে এ ধরনের অভিযোগ ওঠার পরেও জড়িত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ বিরল।
২০২০ সালে একটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এভাবে অর্থ পাচারের মাধ্যমে কানাডার টরন্টোয় অনেক ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদ বাড়ি বা সম্পদ কিনে বসবাস করছেন। অনেকে দেশে থাকলেও তাদের পরিবার এসব বাড়িতে বসবাস করে, যা সেখানকার বাংলাদেশিদের কাছে ‘বেগমপাড়া’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এরকম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে টরন্টোয় বিক্ষোভও করেছিলেন অভিবাসী বাংলাদেশিরা।
টিআইবি বলেছে, দেশে অনেক সময়ই অর্থ পাচারের ঘটনা উন্মোচন হলেও জড়িত ব্যক্তিরা পরিচয় ও অবস্থানের বলে পার পেয়ে যান। কিন্তু অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ করা গেলে যেমন বাংলাদেশকে আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হতে হতো না, তেমনি দেশে রিজার্ভ সংকটও তৈরি হতো না। সূত্র:বিবিসি
পূর্বকোণ/আরডি