চট্টগ্রাম সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ভাঙন আতঙ্কে নদী-খাল পাড়ের বাসিন্দারা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২০ আগস্ট, ২০২৩ | ১১:২৮ পূর্বাহ্ণ

সাতকানিয়া পৌরসভার দক্ষিণ বোয়ালিয়া এলাকার দিনমজুর মো. রাসেলের সেমিপাকা ঘরের মেঝে গ্রাস করেছে ডলু খাল। হা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরটি। যেকোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যাবে খালের গর্ভে। স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে উদ্বাস্তুর মতো পাশের বাড়িতে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।

 

শুধু তাই নয়, শঙ্খ নদীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে চরতী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সুমন দাশের ঘর। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঘরের কয়েকটি পিলার। পাশের ভাঙাচোরা ঘরের ভগ্নাংশ টিকে আছে। পরিবার নিয়ে দিশেহারা সুমনের চোখে এখন রাজ্যের অন্ধকার। কখন শেষ আশ্রয়টুকুও কেড়ে নেয় সর্বনাশা শঙ্খ।

 

পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় সাতকানিয়া উপজেলার শত শত ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শঙ্খ ও ডলু খালের তীররক্ষা বা বেড়িবাঁধ ভেঙে মানুষের ঘরবাড়ির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। শুধু সাতকানিয়া নয়, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় শত শত ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে অনেক ঘরবাড়ি। এখন পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নদী ও খালের তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা। ঘরবাড়ি ছাড়াও নানা স্থাপনা ও ফসলি জমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদী ও খালের গর্ভে। প্রায় ১২ কিলোমিটার নদী-খালের তীর ও বেড়িবাঁধ ভেঙেছে বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। সংস্কারের জন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ চেয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।  জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ও ত্রাণ শাখা জানায়, জেলায় ২৮ হাজার ৭০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাতকানিয়া, চন্দনাইশ ও লোহাগাড়া উপজেলায়। সাতকানিয়ায় দুই হাজার ৪৭৯টি ঘর আংশিক ও নয় হাজার ১৮৫টি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। চন্দনাইশে চার হাজার ১২০টি ঘর আংশিক ও ৬ হাজার ৩৭৯টি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লোহাগাড়ায় ২৫শ ঘর আংশিক ও দুই হাজার ঘর সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, পাহাড়ি ঢল, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যায় নদী-খালের তীর এবং বেড়িবাঁধের ১২ কিলোমিটারের বেশি ভেঙে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলে সাঙ্গু, ডলু, টঙ্কাবতী খালের ভাঙন তীব্র রূপ ধারণ করেছে। এছাড়াও কর্ণফুলী ও হালদা নদী এবং নদী সংলগ্ন বিভিন্ন খালের ভাঙনও বাড়ছে।

 

জেলার সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া উপজেলায় সাঙ্গু, টঙ্কাবতী, কর্ণফুলীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি অতিরিক্ত বেড়ে যায়। পাহাড়ি ঢল, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যার তোড়ে উপকূলীয় এলাকা এবং বেড়িবাঁধ ভেঙেচুরে চুরমার করে ফেলেছে। বাঁধ ছাড়াও রেগুলেটরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

দেখা যায়, রাউজান উপজেলায় কর্ণফুলী, হালদা নদী ও সর্তা-ডাবুয়া খালের ২৯ স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা, মেখল, বোয়ালিয়া, গড়দুয়ারা ইউনিয়নের মান্দারী, বোয়ালিয়া, চেংখালী, প্যারাখালী খালের ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে মান্দারী রেগুলেটর, বোয়ালিয়া রেগুরেটর, হালদার ডানতীরে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ এলাকায় ভাঙন তীব্র হয়েছে। রাঙ্গুনীয়ার সরফভাটা, বেতাগী, পদুয়া ইউনিয়নে কর্ণফুলী নদী ও শাখা খালের বিভিন্ন স্থানে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে।

 

এছাড়াও সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা উপজেলায় সাঙ্গু ও বঙ্গোপসাগরের পানির আঘাতে তীরবর্তী এলাকার ঘরবাড়ি, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। ফটিকছড়ি ও হাটহাজারীতেও পানির তোড়ে বেড়িবাঁধ এবং উপকূলীয় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পওর-১) নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ পূর্বকোণকে বলেন, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও আনোয়ারাসহ বিভিন্ন ১০ কিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ ও উপকূলীয় এলাকা সংস্কার করার জন্য অন্তত ৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছি। কারণ জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙনরোধ করা না গেলে জলোচ্ছ্বাস দেখা দিলে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করার আশঙ্কা রয়েছে।

 

সরেজমিন দেখা যায়, শঙ্খের ভাঙনে সাতকানিয়ার চরতী ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সুমন দাশ, সনজিৎ দাশগুপ্ত, ডা. পুলক দাশগুপ্ত, মাস্টার মিলন কান্তি দাশের ঘরবাড়ি তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে। কয়েকটি স্থানে দেখা যায়, ঘরের অর্ধেক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেক বিলীন হওয়ার পথে। এসব ঘরবাড়ি ছাড়াও ভিটা-জমি ও অন্যান্য অবকাঠামোও ভাঙনের মুখে পড়েছে।

 

প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ আরও বলেন, সাতকানিয়ার ব্রাহ্মণডাঙ্গা ও চরতী ইউনিয়ন, চন্দনাইশের বৈলতলী ইউনিয়নের দ্বীপপাড়া অংশে শঙ্খের ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। জরুরিভিত্তিতে ভাঙনরোধে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। দু-তিনদিনের মধ্যে আনোয়ারা জুঁইদ-ী ও সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের কাজ শুরু করে। সবমিলে আপৎকালীন সাড়ে তিন কোটি টাকার কাজ শুরু হচ্ছে।

 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের রাঙামাটি পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা বলেন, টানা বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ¯্রােতে রাউজান, রাঙ্গুনীয়া, হাটহাজারী ও রাঙামাটির বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ এবং উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দ্রুত সংস্কার করা না গেলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। জরুরিভিত্তিতে সংস্কারের জন্য সাড়ে ৬ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট