চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বিদ্যুতায়নে বদলে যাচ্ছে কুতুবদিয়ার দৃশ্যপট

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুতুবদিয়া

২৫ জুলাই, ২০২৩ | ৯:৫৯ অপরাহ্ণ

দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়া। পর্যটন নগরী কক্সবাজার থেকে প্রায় ৭৫ কিলোমিটার উত্তরে সমুদ্রবেষ্টিত উপকূলীয় এ দ্বীপের অবস্থান।

ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে গভীর সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় সেখানে। একসময় সন্ধ্যা হলেই নেমে আসতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। দীর্ঘদিনের বিদ্যুৎহীনতায় চরম বিপর্যস্ত ছিল স্থানীয়দের জনজীবন। বিদ্যুতের অভাবে দাপ্তরিক কাজ না করে অলস সময় কাটাতে হতো সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। যুগের পর যুগ হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবায় ছিল ভূতুড়ে অবস্থা! মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় প্রাণহানিসহ দরিদ্র রোগীদের দুর্ভোগ আর ভোগান্তি ছিল অন্তহীন। এককথায় জেলায় স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার হারে শীর্ষে থাকলেও উপকূলীয় এ দ্বীপ উন্নয়নের দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল।

স্বাধীনতার প্রায় ৫২ বছর পর চলতি বছরের (১২ এপ্রিল) জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় শতবর্ষ ধরে অবহেলিত দুর্গম দ্বীপ কুতুবদিয়া। সম্প্রতি শতভাগ বিদ্যুতায়ন প্রকল্পসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজে বদলে যাচ্ছে এর দৃশ্যপট। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেখানকার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উন্নত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকায় দ্বীপের অসংখ্য মানুষ চাহিদা অনুযায়ী সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। গর্ভবতী প্রসূতিদের কাছে নরমাল ডেলিভারি ছাড়া সিজার (অস্ত্রোপচার) সেবা ছিল কাল্পনিক। বিদ্যুতায়নের ফলে দ্বীপে বসবাসরত মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলার একমাত্র স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবার মান ব্যাপক বেড়েছে। প্রসূতি-গর্ভবতী নারীদের মুমূর্ষু অবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে ভরা বর্ষায় উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে এখন আর যেতে হয় না চকরিয়া, কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম শহরে।

বর্তমানে প্রসূতিদের নিয়মিত সিজারিয়ান (অস্ত্রোপচার)-এ ডেলিভারি হচ্ছে উপজেলা হাসপাতালেই। মাধ্যমিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুরু হয়েছে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার। রাতে হাট-বাজারসহ বাড়িঘরে দেখা যায় আলোর ঝলকানি। বিদ্যুতায়নে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সকল ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতিমধ্যে উপজেলা সদরের বড়ঘোপ ও ধুরুং বাজারে চালু হয়েছে ৪-৫টি ইলেক্ট্রনিক্স জাতীয় মালামালসামগ্রী বা ফ্রিজের শো-রুম। পাশাপাশি কেউবা আবার মৎস্য ও কৃষিখাতে পরিবর্তন ঘটাতে বিদ্যুতের ব্যবহার কাজে লাগিয়ে ফিশিং ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে ডকইয়ার্ড, ফিশারি ঘাট ও বরফের কারখানাসহ পাড়া মহল্লায় গরু-মহিষের খামার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। এককথায় জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর দ্বীপের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আর তাতেই আশায় বুক বেঁধেছেন এখানকার প্রায় দু’ লাখ মানুষ।

এ অঞ্চলে ১৯৮০ সালে জেনারেটরের মাধ্যমে সন্ধ্যাকালীন সময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ক্ষুদ্র পরিসরে জেনারেটরের মাধ্যমে উপজেলা সদর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া ২০০৮ সালের পর দফায় দফায় প্রায় ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ৭০টি বায়ুকল দ্বারা বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হলেও তা তেমন উপকারে আসেনি স্থানীয়দের।

শতভাগ বিদ্যুতায়নে হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়ায় (অর্থ বছর ২০২১-২২)’র  ৪০০ কোটি টাকার বাজেটে প্রকল্প বাস্তবায়নে সুফল ভোগ করছেন দ্বীপের অনেক মানুষ।

অবহেলিত দুর্গম এই জনপদে জাতীয় গ্রিডে সাগরের তলদেশ দিয়ে (সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে) বিদ্যুৎ আসবে তা কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি স্থানীয়রা। প্রায় ৬শ বছর আগে সৃষ্ট এ অঞ্চলের মানুষের সৌখিন জীবনযাপন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদকাল শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে বিচ্ছিন্ন এই সমুদ্র জনপদ।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) কুতুবদিয়া শাখার আবাসিক প্রকৌশলী মো. আবুল হাসনাত জানান, বর্তমানে সমগ্র দ্বীপে প্রায় ৩ হাজার গ্রাহক জাতীয় গ্রিডের আওতাভুক্ত। ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন তারা। তাছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে অনেকে আবেদন করছে। ক্রমান্বয়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দ্বীপের প্রতিটা ইউনিয়নে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

উপজেলা মেরিন ফিশারিজ অফিসার মো. নাজমুস সাকিব বলেন, মৎস্যখাতের উপার্জন নিয়ে দ্বীপের সিংহভাগ মানুষ জীবন-জীবিকা চালালেও তেমন কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি এ শিল্পে। তবে বিদ্যুতায়নের ফলে এবার প্রযুক্তির ব্যবহারে স্থানীয় মৎস্য ব্যবসায়ী ও জেলেরা অতীতের চেয়ে বাণিজ্যিকভাবে বহুগুণে লাভবান হবে বলে জানান তিনি।

ধুরুং ফিশিং বোট মালিক সমিতির প্রচার সম্পাদক মহি উদ্দীন বলেন, কুতুবদিয়ায় হাজার হাজার ফিশিং বোট রয়েছে। তবে মাছ বিক্রি, বরফ সংগ্রহ ও বোট মেরামতের জন্য কোনো সুযোগ সুবিধা ছিল না। এখন বিদ্যুতায়নের কারণে কুতুবদিয়ায় বরফমিল, বোট মেরামতের প্রযুক্তির ব্যবহার হবে বলে জানান তিনি।

কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কুতুবদিয়ায় বিভিন্ন খাতে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।

প্রধান দু’টি বাজারে ৪/৫টি ফ্রিজের শো-রুম হয়ে গেছে। এখন মানুষ বাজারে ফ্রিজের আইসক্রিম খাচ্ছে, যা আগে ছিল কেবল স্বপ্ন। শীত মৌসুমে সৌর প্যানেলের বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বিভিন্ন অফিসে দাপ্তরিক কাজে ব্যাঘাত ঘটতো।

এখন আর সেটা হবে না। তাছাড়া অর্থনৈতিকভাবে মৎস্য শিল্পে লাভবানের জন্য ব্যক্তি উদ্যোগে বরফের কারখানা গড়ে উঠবে বলে জানান তিনি।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট