চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা

কর্ণফুলীতে ২৪৯২ অবৈধ স্থাপনা

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

১৭ জুলাই, ২০২৩ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে ২ হাজার ৪৯২টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। নদীর তীরবর্তী চট্টগ্রামের ৭ উপজেলা ও রাঙামাটির ২ উপজেলায় সমীক্ষা চালিয়ে এসব অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে সরকারি এই সংস্থাটি।

 

২০১৫ সালে হাইকোর্টের আদেশে কর্ণফুলীর সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ স্থাপনার তালিকা করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তাতে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে দুই হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছিল। সাত বছর পর নতুন করে সমীক্ষা করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ সমীক্ষায় নদীর দখল-দূষণ, গতি-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মৎস্যসম্পদ, নদীপাড়ের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, মানুষের জীবনধারা, কৃষি-পর্যটনশিল্প, সামাজিক-অর্থনৈতিক আকৃতি-প্রকৃতি উঠে এসেছে।  জেলা প্রশাসন ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অবৈধ স্থাপনার মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কন্টেইনার ডিপো, জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, মাছ বাজার, জেটি, বস্তি ও বাড়ি-ঘর। রয়েছে ইটভাটা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানাসহ নানা স্থাপনা। সবচেয়ে বেশি দখল হয়েছে কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী ও নগরীতে। ভারী স্থাপনা গড়ে উঠেছে কর্ণফুলী উপজেলা এবং নগরীর বন্দর ও পতেঙ্গা অংশে। দখলদারের তালিকায় রয়েছেন জনপ্রতিনিধি, শিল্পপতি ও  ব্যবসায়ীসহ প্রভাবশালী মহল। নদীর ১০ মিটারের মধ্যে সকল অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশ করেছেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষাদলের সদস্যরা। একই সঙ্গে নদীর তীরে সৌন্দর্যবর্ধক প্রকল্প গ্রহণ ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে নদীর তীরভূমি সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

 

রাঙামাটি ও চট্টগ্রামে অবৈধ স্থাপনা :

নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, রাঙামাটি জেলার সদর উপজেলায় কর্ণফুলী নদীর তীরে অবৈধ স্থাপনা নেই। তবে বরকল উপজেলায় দোকান ও স’মিলসহ ৮টি স্থাপনা রয়েছে। কাপ্তাই উপজেলায় অবৈধ স্থাপনা রয়েছে ৩৯৮টি। কাপ্তাই উপজেলায় কাঁচা-আধাপাকা ঘর-বাড়ি, দোকান ছাড়াও রয়েছে পাকা ভবন, স্টেডিয়াম, পোলট্রি খামার।

 

চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবৈধ স্থাপনা রয়েছে রাঙ্গুনীয়া উপজেলায়। ৯২৭টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে গ্যারেজ, হোটেল, ইটভাটা, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও স’ মিল। বোয়ালখালীতে রয়েছে ২৬৬টি অবৈধ স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে বালুর ব্যবসা, ডকইয়ার্ড, লবণ কারখানা, স’মিল ও গরুর খামার। রাউজানে ১৭১টি অবৈধ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ঘর-বাড়ি, বহুতল ভবন, ফার্নিচার দোকান, স’মিল ও পোলট্টি খামার। পটিয়ায় ১১টি অবৈধ স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ডকইয়ার্ড, বিদ্যুৎকেন্দ্র। ভয়াবহ ও ভারী স্থাপনা রয়েছে নগরীর ওপারে কর্ণফুলী উপজেলায়। বাড়ি-ঘর ছাড়াও সেখানে রয়েছে জেটি, টার্মিনাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সিমেন্ট শিল্প কারখানা, জাহাজ মেরামত কারখানা, চিনির মিল, ফুড প্রসেসিং কারখানা, কয়লার ডিপো, বরফ কল, কোল্ড স্টোরেজ। আনোয়ারায় ১৬টি স্থাপনার মধ্যে রয়েছে জেটি, সার কারখানা, তেলের ট্যাংকার, ডকইয়ার্ড। আর নগরীর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ঘর-বাড়ি, দোকান, জেটি, বন্দর, ডকইয়ার্ড, বহুতল ভবন, তেল পরিশোধন কেন্দ্র, তেল ডিপো, সিমেন্ট কারখানা, কোল্ড স্টোরেজ রয়েছে। ৪৯৮টি স্থাপনা রয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

 

হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ স্থাপনা ও উচ্ছেদ অভিযান :

২০১০ সালে কর্ণফুলী নদীর সীমানা নির্ধারণ, দখলদার চিহ্নিত ও উচ্ছেদ বিষয়ে হাইকোর্টে মামলা করে মানবাধিকার-পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ। সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জনস্বার্থে এ রিট দাখিল করেছিলেন। হাইকোর্টের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে কর্ণফুলীর তীরে ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছিল জেলা প্রশাসন। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আদেশ দেন হাইকোর্ট। ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ডাকঢোল পিটিয়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করে জেলা প্রশাসন। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন ও বন্দর যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে লালদিয়ার চরসহ কয়েকটি স্থানে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এরপর উচ্ছেদ কার্যক্রম আর গতি পায়নি। উপরন্তু দখলদারিত্ব বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত দখল হচ্ছে কর্ণফুলীর তীর।

 

সরেজমিন :

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়ায় পেপার মিল গড়ে উঠেছে কর্ণফুলীর তীরঘেঁষে। কাপ্তাই ও রাঙ্গুনীয়া এলাকায় নদীর তীরে গড়ে ওঠেছে বাজার, দোকান, ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানা। রাঙ্গুনীয়ায় নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে ইটভাটা রয়েছে। তবে ভারী স্থাপনা দেখা যায়- বোয়ালখালী ও পটিয়ায়। বোয়ালখালীর কধুরখীলে নদীর তীরে নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতল ভবন। এছাড়াও জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে কালুরঘাট সেতু পর্যন্ত বিশাল এলাকায় রয়েছে বালু ব্যবসাকেন্দ্র। এসব এলাকায় অন্তত ১৫-২০টি বালু বাণিজ্যকেন্দ্র রয়েছে। কালুরঘাট সেতু ও পশ্চিম গোমদণ্ডীতে নদীর তীরঘেঁষে রয়েছে কাগজ তৈরি, পোশাক কারখানা, জাহাজ নির্মাণ, একাধিক লবণ ও পানি শোধন কারখানা। জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান নদী ও খালের পাড় দখল করেই গড়ে ওঠেছে। লবণ কারখানাগুলো নদীতে একাধিক জেটি নির্মাণ করেছে।

 

পটিয়ার কোলাগাঁও এবং শিকলবাহা এলাকায় নদী পাড় নেই বললেই চলে। অন্তত ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেল খালাসের জন্য নদীতে জেটি নির্মাণ করা হয়েছে।

 

নগরীর মধ্যে ব্যাপক দখল হয়েছে বাকলিয়ার বাস্তুহারা, ক্ষেতচর ও চাক্তাই এলাকায়। নদী তীরের সরকারি খাস জমি দখল করে গড়ে উঠেছে বিশাল বস্তি। কয়েক হাজার ঘর-বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে বস্তিগুলোতে। এছাড়াও চাক্তাই-রাজাখালী খাল এবং নদীর তীর দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে মৎস্য অবতরণকেন্দ্র।

 

শাহ আমানত সেতু থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত অংশে ব্যাপক দখল ও স্থায়ী অবকাঠামো গড়ে ওঠেছে। রয়েছে বহুতল ভবনও। এরমধ্যে সরকারি নানা স্থাপনাও রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

 

দখলে সরু হচ্ছে কর্ণফুলী :

নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন ২০২১ সালে কর্ণফুলী নদী নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শাহ আমানত সেতু এলাকায় জোয়ারের সময় প্রস্ত ছিল ৫১০ মিটার। ২০১৪ সালে পরিচালিত জরিপে ছিল ৮৮৬ মিটার। একইভাবে চাক্তাই খালের মোহনার প্রস্ত ৮৯৮ মিটার থেকে কমে দাঁড়ায় ৪৩৬ মিটার। কর্ণফুলী গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বলেন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলীর দখল ও দূষণে জড়িত। দখলের কারণে দিন দিন নদীর প্রশস্ততা কমেছে।

 

নদী কমিশনের তালিকায় অবৈধ স্থাপনা :

নদী কমিশনের তালিকায় ২ হাজার ৪৯২ অবৈধ স্থাপনার মধ্যে টিনের ঘর রয়েছে ১ হাজার ৪৫৪টি। পাকা স্থাপনা ৫৭২টি, আধা পাকা স্থাপনা ৭০টি, মাটির ঘর ৯৩টি, ডকইয়ার্ড ১৬টি, স’মিল ২২টি, পোলট্টি ও গরুর খামার ২০টি, তেলের দোকান ১১টি, জেটি ৬১টি, ইটভাটা ১২টি, কয়লার ডিপো ১টি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ১০টি, পুকুর ৪টি, পানের বরজ ১টি, শুঁটকির মাচান ৬টি, বালুর ব্যবসা ৬টি, শিল্প কারখানা ২০টি, সরকারি স্থাপনা ৬টি ও অন্যান্য স্থাপনা ৫৫টি।

পূর্বকোণ/মাহমুদ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট