চট্টগ্রাম সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

হালদার প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননের গুরুত্বপূর্ণ অণুঘটক ও বিশ্লেষণ

২২ জুন, ২০২৩ | ১২:০২ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একমাত্র নদী হালদা। ২০১৬ সালে যখন হালদা থেকে কোন ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি তখন থেকেই হালদা নিয়ে সবাই নড়েচড়ে বসে। হালদা পাড়ের সন্তান প্রাক্তন মুখ্য সচিব ড. আব্দুল করিমের নেতৃত্বে এগিয়ে আসে সরকারি সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন এবং আইডিএফ। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যালয় থেকে সাবেক মহাপরিচালক (প্রশাসন) কবির বিন আনোয়ারকে পাঠান হালদা নদীর উপর একটা রিপোর্ট করার জন্য। এরপর থেকে মূলত হালদা নদী প্রশাসনিক নজরদারিতে আসে। ২০১৭-১৮ সাল থেকে উজান অঞ্চলের তামাক চাষ নির্মূল কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত এই নদী একটি সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে। এই নদী রক্ষার সাথে ২০১৯ সালে যুক্ত হন বিশেষায়িত বাহিনী বাংলাদেশ নৌ পুলিশ।

 

২০২০ সালে নদীর বিভিন্ন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র এই নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে। হেরিটেজ ঘোষণার পর থেকে এই নদী সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, নৌ পুলিশ, সরকারি সংস্থা পল্লীকর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, আইডিএফ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি নজরদারি এই নদী সরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিশেষ ভূমিকায় হালদা দূষণের কারণে ফার্নেস অয়েলে পরিচালিত একটি সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বেসরকারি একটি পেপার মিল সরকার বন্ধ করে দেয়। বেসরকারি সংস্থা পিকেএসএফ এবং আইডিএফের বিশেষ তৎপরতায় মানিকছড়ির তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। স্থানীয় প্রশাসন, নৌ পুলিশ এবং এনজিও আইডিএফের বিশেষ ভূমিকায় হালদার ব্রুড মাছ নিধন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হালদা নদীর যে কোন সমস্যার তাৎক্ষণিক চিহ্নিতকরণ, সমাধান, মনিটরিং এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল নির্ধারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় একক নদী ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি। এখন দক্ষিণ এশিয়ার নদী ব্যবস্থাপনায় হালদা নদী একটি রোল মডেল। যার জন্য হালদা নদীর প্রতি দেশবাসীর প্রত্যাশা বেড়ে যায়।

 

বহুমাত্রিক এত উদ্যোগের পরেও ২০২০ সালের পর হালদা নদী থেকে যখন প্রত্যাশিত ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ২০২১ সালে পর্যাপ্ত ডিম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি কারণ এবছর ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, অনাবৃষ্টি এবং লবণাক্ততা। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাস হালদার রুই জাতীয় মাছের প্রজনন সময়। এই তিন মাসের মধ্যে প্রতি মাসের আমাবস্যা অথবা পূর্ণিমা তিথিতে ভারী বৃষ্টিপাত হলে পরে নদীতে মাছ ডিম ছাড়ে। কিন্তু এবছর এপ্রিল-মে দুই মাস অতিবাহিত হলেও হালদার নদীর উজান অঞ্চলে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হয়নি, ফলে পাহাড়ি ঢল না আসায় নদীতে মাছের ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়নি।

 

মে মাসের চতুর্থ জো অর্থাৎ পূর্ণিমা তিথি ছিল ২৩ থেকে ২৯ তারিখ। এ সময় অল্প পরিমাণ বৃষ্টি হলে মাছের গোনাড পরিপক্বতার কারণে মাছ ডিম ছাড়ার জন্য তৈরি হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সাগর উত্তাল হয়ে ওঠে। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। একই সাথে হালদা নদী জোয়ার-ভাটার নদী হওয়ার কারণে জোয়ারের সময় পানির উচ্চতা অনেক বৃদ্ধি পায়। এই জোয়ারের পানির সাথে হালদা নদীর পানিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটে। একই সাথে নদীর উজান অঞ্চলে প্রত্যাশিত বৃষ্টি না হওয়ায় কারণে পানির প্রেসার না থাকায় প্রজনন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রবণতাকে আরো প্রভাবিত করেছে। একটি সরকারি হ্যাচারি এবং মাটির কুয়ায় নদীর লবণাক্ত পানি দিয়ে ডিম ফুটানোর কারণে অধিকাংশ রেণু নষ্ট হয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি এবছর হালদা নদীতে সর্বোচ্চ ৩.৬ পিপিটি লবণাক্ততার পরিমাণ রেকর্ড করে, যা হালদা নদীর পানির লবণাক্ততার স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

 

২০২২ সালে হালদা নদীর মৎস্য প্রজননের সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল অনাবৃষ্টি। বিগত সময়ের রেকর্ড অনুযায়ী এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে অধিকাংশ মাছের প্রজনন করে থাকে। কিন্তু এবছর চট্টগ্রামে এই তিন মাসে মাছের প্রজনন করার মত যথেষ্ট পরিমাণ বৃষ্টি হয়নি। ২০২২ সালে চট্টগ্রামের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের শতকরা ৪০ ভাগ বৃষ্টি হয়েছিল, যা ছিল বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত। এবছর শুধু হালদা নদীতেই নয়, চট্টগ্রামের বিলে দেশীয় মাছের প্রজননও ব্যাহত হয়েছে। পরিবেশগত এই বাধার কারণে হালদা নদীতে মাছের প্রজননের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ব্যাহত হয়। কিন্তু মাছের গোনাড এর পরিপক্বতার কারণে সামান্য অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়তে বাধ্য হয়। যার জন্য হালদা নদীতে প্রচুর মাছের অবস্থান এবং দূষণ মুক্ত থাকা সত্ত্বেও রুই জাতীয় মাছ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রত্যাশিত ডিম ছাড়েনি।

 

চলতি বছরে (২০২৩) হালদা নদীতে তিন ধরণের বাঁধার সম্মুখিন হয়। এপ্রিল-মে মাসজুড়ে প্রচণ্ড তাপদাহ বা উচ্চ তাপমাত্রা (৪০০-৪২০সে.) হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন পরিবেশ বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার শঙ্কা করেছিলাম, বিশেষ করে পানির গুণগত মানের পরিবর্তন, খাদ্যের প্রাচুর্যতার ব্যাঘাত এবং মাছের শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। কারণ মাছের ডিম ধারণ এবং পরিপূর্ণতার জন্য একটা স্বাভাবিক (২৬০-৩২০ সে.) তাপমাত্রা প্রয়োজন।

 

লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধিতেও হালদা নদীর রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন ছিল। হালদা নদীর পানিতে লবণাক্তার পরিমাণ ইতোমধ্যে ৩.৫ পিপিটি অতিক্রম করেছে। ইতোমধ্যে ডিম ছাড়ার পাঁচটি জো অতিক্রান্ত হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ বৃষ্টি ছাড়া। এ মাসের ১৫-২১ জুন ছিল ৬ষ্ঠ জো। হালদা নদীর সাথে আমার সম্পৃক্তার ২৩ বছরের মধ্যে হালদা নদীর মাছের প্রজনন কখনো ৬ষ্ঠ জো অতিক্রম করেনি। পরিশেষে গত ১৭ জুন মানিকছড়ি, ফটিকছড়ির পাহাড়ি অঞ্চলে প্রত্যাশিত বৃষ্টি হয়। ১৮ জুন সকাল বেলায় প্রজনন ক্ষেত্রে পাহাড়ি ঢল নামে। একই তারিখ সকালে নমুনা ডিম দেখা দিলে ডিম সংগ্রহকারীরা সকল প্রস্তুতি নিয়ে নদীতে অবস্থান করে এবং রাতের জোয়ারে রুই জাতীয় মাছ প্রত্যাশিত ডিম ছাড়ে।

 

গত ৯ মে তারিখ দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত ‘হালদা নদীতে চলমান তাপদাহ এবং লবণ পানির প্রভাব’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, তত্ত্বীয়ভাবে উপরের তথ্যগুলো প্রমাণিত সত্য হলেও আশার কথা হচ্ছে যেহেতু হালদা নদী একটা জোয়ার ভাটার প্রবাহমান নদী এখানে প্রতিদিন দুইবার করে জোয়ার এবং ভাটা হয়, এই জোয়ার ভাটা এবং নদীর গভীরতার কারণে উপরোক্ত ক্ষতির কারণগুলো অনেকটা প্রশমিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আগামী জো’গুলিতে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততার প্রভাব কমে আসবে এবং হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

 

হালদা নদীর সাথে আমার বিগত ২৩ বছরের সম্পৃক্ততা এবং গবেষণালব্দ তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে হালদা নদীর মাছের প্রজননের জন্য দুই ধরণের ফ্যাক্টর কাজ করে। প্রথমত কিছু ফ্যাক্টর আছে যাদের আমরা কন্ট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর বলি যা মাছের প্রজননে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং কম বেশি হলে প্রজননও একই মাত্রায় ওঠানামা করে। যেমন টার্বিডিটি বা ঘোলাত্ব, প্রিসিপিটেশন/ বৃষ্টিপাত, জোয়ার ভাটা, জো, প্রাপ্তবয়স্ক মাছ ইত্যাদি। আর দ্বিতীয়ত কিছু ফ্যাক্টর আছে যাদের আমরা রেগুলেটিং ফ্যাক্টর বা নিয়ন্ত্রক ফ্যাক্টর বলি যা একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় না থাকলে মাছ ডিম ছাড়েনা। যেমন দ্রবীভূত অক্সিজেন বা (ডিও), পিএইচ, কার্বনডাই অক্সাইড, লবণাক্ততা, কনডাক্টিভিটি, রেসিসটিভিটি, তাপমাত্রা ইত্যাদি।

 

গত পাঁচ বছরের (২০১৯ থেকে ২০২৩) প্রজনন সময়ের কন্ট্রিবিউটিং এবং রেগুলেটিং ফ্যাক্টরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ২০২০ (২৫,৫৩৬ কেজি) এবং ২০২৩ (পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি) সালে সর্বাধিক পরিমাণ ডিম ছেড়েছে। একই সাথে ২০১৯ (৬৯৮৬ কেজি) ২০২১ (৮৫৮০ কেজি) এবং ২০২২ (৭২৩৫ কেজি) সালে কম পরিমাণ ডিম পাওয়া গেছে। ২০২১ সালের বাধা ছিল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, অনাবৃষ্টি এবং লবণাক্ততা বৃদ্বি, যার কারণে পাহাড়ি ঢল ছাড়া ডিম ছাড়তে হয়েছে। ২০২২ সালেও অল্প বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল ছাড়া ডিম ছাড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালেও একইভাবে পাহাড়ি ঢল ছাড়া ডিম ছাড়তে হয়েছে, অর্থাৎ এই বছরগুলোতে পাহাড়ি ঢল না আসার কারণে পানির গড় টার্বিডিটি বা ঘোলাত্ব ছিল ৫০-১২০ (এনটিইউ) এর মধ্যে।

 

অন্যদিকে ২০২০ এবং ২০২৩ সালে অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলো স্বাভাবিক মাত্রায় থাকলেও পাহাড়ি ঢল নামার কারণে পানির টার্বিডিটি বা ঘোলাত্ব ছিল ৬০০-৭০০ (এনটিইউ) এর মধ্যে। একই সাথে পাহাড়ি ঢল লবণাক্ততা নিরসনেও ভূমিকা পালন করে। এই তথ্য থেকে সুষ্পষ্ট যে হালদা নদীর মাছের স্বাভাবিক প্রজননের জন্য পাহাড়ি ঢল তথা এর ফলে বৃদ্ধি পাওয়া ঘোলাত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কন্ট্রিবিউটিং ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো হালদা জোয়ার ভাটার নদী হওয়ায় সুনির্দিষ্ট সময় পর এই ঘোলাত্ব কমে যায়, যা ডিম ছাড়ার পর মাছের স্বাভাবিক শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

 

পাহাড়ি ঢল ছাড়া যে বছরগুলোতে প্রজনন হয়েছে সে বছরগুলোতে ডিমের পরিমাণ ছিল অত্যন্ত কম। সুতরাং হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের প্রজনন পরিবেশের জন্য পানির অন্যান্য ফ্যাক্টরগুলোর সাথে টার্বিডিটি বা ঘোলাত্বের এই পরিবর্তন রক্ষায় আমাদের প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ি ঢল যাতে আসতে পারে, এবং হালদার উজান অঞ্চলের কোন অব্যবস্থাপনা যাতে এই ঢলকে প্রশমিত করতে না পারে সেদিকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে।

অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া, চেয়ারম্যান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ

সমন্বয়ক, হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট