চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

সর্বশেষ:

পরকালে গুজবের ভয়াবহ শাস্তি

মুহাম্মদ মোরশেদ আলম

১৪ অক্টোবর, ২০২৪ | ৪:২১ অপরাহ্ণ

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী। এগুলো হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, ইমু প্রভৃতি। এরমধ্যে ফেসবুক হচ্ছে সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত। তাই যেকোনো তথ্য মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যম হয়ে উঠেছে এটি। প্রযুক্তির এই উন্নয়ন মানুষের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। গোটা মানবজাতিকে গতিশীল করেছে। মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরের মানুষটি হয়ে যাচ্ছে গল্প বা আড্ডার সঙ্গী। অবিরাম চলছে ভাব ও শুভেচ্ছা মতবিনিময়, সমবেদনা কিংবা সহমর্মিতা প্রকাশ। মতের মিল না থাকলেও সবাই যেন একই পরিবাবরভুক্ত। পজেটিভ- নেগেটিভ পোস্ট ও কমেন্ট এবং ভাইরাল নিউজের ছড়াছড়ি।
পাশাপাশি দুষ্কৃতকারীরা এই মাধ্যমকে গুজব ছড়ানোর হাতিয়ারে পরিণত করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে এই গুজব ও মিথ্যার সয়লাব প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।
আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে গুজব, অপপ্রচার মহামারির আকার ধারণ করেছে। কখনো কখনো অতিরিক্ত আবেগের বশবর্তী হয়েও ভিত্তিহীন কথা প্রচার করা হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে দেওয়া যেন কিছু মানুষের রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যুগটাও চলছে এখন সোশ্যাল মিডিয়ার। যেহেতু বর্তমান যুগের বেশির ভাগ মানুষের এখানে বিচরণ, তাই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তারা এই প্ল্যাটফরমকে বেছে নিয়েছে। গুজব মানুষের মধ্যে তৈরি করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করে। এমনকি ধর্ষণ, হত্যা ও গণহত্যার মত ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়।
ব্যক্তিগত আক্রোশ ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব পুঁজি করেই এ ধরনের কাজ বেশি করা হচ্ছে। নিজেদের আদর্শের বাইরে হলেই তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ানো, ফটোশপে কারসাজির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিত্বকে অপমানের চেষ্টা করাই এখন যেন এক শ্রেণির মানুষের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
গুজব মানে মিথ্যা রটানো যার কোন ভিত্তি নেই । ইসলাম সত্যের ধর্ম । ইসলাম ধর্মে মিথ্যার কোন স্থান নেই। মিথ্যাবাদীদের জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। ইসলামের দৃষ্টিতে গুজব ও অপপ্রচার খুবই গর্হিত কাজ। গুজব রটানোর পিছনে উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা, মানুষের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করা । আল্লাহপাক কুরআনে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করা মুনাফিকের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর মুনাফিকের স্থান জাহান্নামে। গুজব ছড়িয়ে যারা মানুষের সম্মানহানি করে, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধানও রয়েছে ইসলামে। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারীদের এবং কাফেরদের জন্য রয়েছে দোজখের আগুন। তাতে তারা চিরদিন থাকবে। সেটাই তাদের জন্যে যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এবং তাদের জন্যে রয়েছে স্থায়ী আজাব। (সূরা তাওবাহ আয়াত ৬৮)।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ বা পাপ অর্জন করে, অতঃপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর তা আরোপ করে, তাহলে সে তো মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য গুনাহের বোঝা বহন করল। (সুরা : নিসা, আয়াত : ১১২)
কোনো খবর দেখলেই যাচাই-বাছাই করা ছাড়া তা বিশ্বাস করা অনুচিত। পবিত্র কোরআনে ভুল তথ্য অনুসরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর—এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)
মিথ্যা বলা বা গুজব ছড়ানো মুনাফিকের আলামত। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি : ১. যখন সে মিথ্যা কথা বলে, ২. ওয়াদা করলে ভঙ্গ করে, ৩. আর যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খিয়ানত করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৩)
ইসলামের দৃষ্টিতে তথ্য একটি পবিত্র আমানত। প্রতিটি আমানতের ব্যাপারে মহান রব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। যারা সমাজে গুজব রটিয়ে বা মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টে প্রয়াসী হয়, তারা খেয়ানতকারী, ফাসিক ও মুনাফিক। মহান রব্বুল আলামিন তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা কাসাস, আয়াত ৭৭)
আবার গুজব ছড়ানোর কারণে এতে বিভ্রান্ত হয়ে যদি সমাজে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, কোনো গুনাহের প্রচলন হয়ে যায়, এর দায়ভারও যিনি গুজব ছড়িয়েছেন তার ওপর এসে বর্তাবে।
অনেকের মধ্যে নিজের বিশ্বাস প্রচারের প্রবণতা দেখা যায়, যারা প্রচারিত কোনো সংবাদ নিজের মতো, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে হলে তা যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করে না। পাওয়ামাত্রই প্রচার শুরু করে। ইসলাম এই প্রবণতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সব শোনা কথার প্রচার ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৯২)
হাদিসবিশারদরা এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোনো কথা শুনেই প্রচারের প্রবণতা মিথ্যায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়। ফলে সে পৃথিবীতে লজ্জিত হয় এবং পরকালেও তার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। আবদুল্লা ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসেও গুজবকে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে এবং তাদের মিথ্যা কথা শোনায়। অতঃপর লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ বলে, আমি এমন এক ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনেছি, যার চেহারা চিনি, কিন্তু নাম জানি না।’ (সহিহ মুসলিম)
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থ জড়িত থাকে। এমন সংবাদের প্রচার মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে রক্ষা করে এবং কখনো কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় থেকেও আত্মরক্ষার উপলক্ষ হয়। এমন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, সংবাদ প্রচারের আগে অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ৬)
গুজব ছড়িয়ে অন্যের মানহানি করা, দোষচর্চা করা বা কাউকে অপবাদ দেওয়াকে ইসলাম পাপ বলে গণ্য করেছে। এ ব্যাপারে মহানবি (স.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজ ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। (বুখারি, মুসলিম) তবে কারো অপরাধ যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যা সমাজ, মানবতা বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, তাহলে জনগণকে সচেতন করার জন্য তা প্রকাশে কোনো অসুবিধা নেই। এ সম্পর্কে মহান রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, আল্লাহ মন্দ কথার প্রচার-প্রসার পছন্দ করেন না, তবে যার ওপর জুলুম করা হয়েছে (তার কথা ভিন্ন)। (সুরা নিসা, আয়াত ১৪৮) এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, নিপীড়িত জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা এবং জনসম্মুখে অপরাধসমূহ প্রকাশ করা সর্ম্পূণ বৈধ।
বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে বিরোধ উস্কে না দিয়ে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া ইসলামে অনেক বড় ফজিলতের বিষয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমি কি তোমাদের রোজা, নামাজ ও সদকা থেকেও উত্তম বিষয় সম্পর্কে বলব না? সাহাবিরা বলেন, আল্লাহর রাসুল! অবশ্যই বলুন। তিনি বলেন, বিবাদরতদের মধ্যে মীমাংসা করা। আর জেনে রেখো, পরস্পর বিবাদ মানুষের দ্বিন-ধর্ম মুণ্ডিয়ে দেয়। (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০৯)। কেননা সামান্য ভুলভ্রান্তির কারণে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই দ্রুত বিবাদ নিষ্পত্তি করে ফেলা জরুরি।
মিথ্যা প্রচার ও গুজব রটনা সম্পর্কে কোরআন-হাদিসের এসব বাণী বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, গুজবের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। সুতরাং কোনো অবস্থাতেই গুজবে কান দেওয়া যাবে না, গুজব বিশ্বাস করা যাবে না। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো কিছু বলা ও প্রচার থেকে বিরত থাকতে হবে।
বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে গুজবনির্ভর কিছু ঘটনায় সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্টসহ মানুষের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাস্তবিক পক্ষে একটি মিথ্যা তথ্য ও গুজব রটানো ব্যক্তি, সামাজিক বন্ধন ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।
পৃথিবীর ইসলামসহ কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মের লোকজনের ওপর হামলা, বাড়িঘর ও উপাসনালয় ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং হত্যার কথা বলা হয়নি। বরং এগুলো দেশের কিছু দুর্বৃত্তের কাজ যারা সমাজে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ লাগিয়ে দিয়ে সুবিধা লুটতে চায়। অনেকেই আবার এদেরকে ক্ষমতায় টিকে থাকার কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে।
মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে নিষেধবাণী ঘোষিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬)।
তাই সবার দায়িত্ব হলো, সমাজে কোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেই তার প্রচার ও প্রসার না করা। বরং এর বাস্তবতা যাচাই-বাছাই করে নিজে সতর্ক থাকা এবং অন্যকে সতর্ক করা। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে সমাধানের চেষ্টা করা। গুজবের এই ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন কঠোর আইন, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা।

লেখক: মুহাম্মদ মোরশেদ আলম, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট