চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

শিশু ও বিহঙ্গপ্রেমী পেয়ারা নবি হযরত মুহাম্মদ (সা.)

রশীদ এনাম

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ | ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কিরে তোর কণ্ঠের গান এমন মধুর লাগে,

ওরে গোলাপ নিরিবিলী, নবীর কদম ছুঁয়েছিলি, তাঁর কদমের খোশবু  আজও তোর আতরে জাগে’। -কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ও প্রচারক পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আরবের মক্কা নগরীর বনেদি কুরাইশ বংশে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। নবীজির পিতার নাম আবদুল্লাহ্, মাতার নাম আমিনা। বিধির কি ইচ্ছা নবীজির জন্মের পূর্বে তাঁর পিতা সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মদিনায় কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। মহানবী (সা.) এর বয়স যখন ৬ তখনই মা আমিনা (রা.) ইন্তেকাল করেন। জন্মের পর নবীজির পিতামহ আবদুল মুত্তালিব শিশু মুহাম্মদ (স.) লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন। তাইফবাসি কোরেশ বংশের বনি সআদ গোত্রের মেয়ে মা-হালিমা এতিম শিশু মুহাম্মদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নেন। মা হালিমা (রা.) ছিলেন নবীজির দুধ মাতা।

এতিম শিশু মুহাম্মদকে হালিমা ঘরে নিয়ে আসার পর হালিমার পরিবারে আনন্দের বন্যা বইতে লাগলো। মা হালিমা লক্ষ্যে করলেন, তাঁদের গৃহপালিত রুগ্ন পশুগুলি দিনে দিনে তাজা হয়ে উঠছে। আগের চেয়ে বেশী দুধ দিচ্ছে। মরুর বাগানের খেজুর গাছে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী ফলন ফলছে। আরব জাহানের শুষ্ক মাটির সবুজ প্রকৃতির মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি হয়। তাই তো কবি কাজী নজরুল সৌরভপূর্ণ সদ্য ফুটন্ত গোলাপের সাথে তুলনা করেছেন। চন্দ্র সুরুজ, গ্রহ তারা, আকাশ বাতাস, বৃক্ষলতা বেহেশতের হুর পরীসহ পুরো বিশ্ব জাহানের মাখলুক মাতোয়ারা- ‘সাহারাতে ফুটল রে ফুল/রঙিন গুলে লালা। সেই ফুলেরই খোশবুতে আজ দুনিয়া মাতোয়ালা’।

শুধু বৃক্ষ নয় প্রিয় নবীজি (সা.) ফুল এবং শিশুকেও অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি তাঁর প্রিয় দুই দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান (রা.) ও হোসাইন (রা.) কে বলতেন, ‘দুজন এই পৃথিবীতে আমার দু’টি সুগন্ধময় ফুল’ (তিরমিজি)। হযরত মুহাম্মদ (স.) শিশুদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। যে কোন মুসলিম অমুসলিম শিশু পেলে তাকে জড়িয়ে ধরতেন আদর করতেন। শিশুদের কাছে পেলে চুম্বন করে বলতেন- ‘এরা মানুষকে ভীরু ও কৃপণ করে দেয়, আর এরা হলো আল্লাহর ফুল’।

ইশকুলবেলায় ‘মহানবীর দয়া’ গল্পে পড়েছিলাম আজো গল্পটি হৃদয় স্পর্শ করে। শিশুদের প্রতি প্রিয় নবীজির স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা ছিল অফুরান। এক ঈদে নামাজ শেষে ঘরে ফিরছিলেন নবীজি (সা.) তিনি দেখেন মাঠের এককোণে তুলতুলে এক কোমল শিশু খুশির দিনে কাঁদছে। নবীজি শিশুটিকে দেখে কাছে গিয়ে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলেন, শিশুটি বললেন, ‘তার বাবা মা নেই। কেউ আমাকে আদর করে না। আমাকে ভালোবাসে না। আমি কোথায় যাবো?’ এতিম শিশুটি কথা শুনে নবীজির হৃদয় কেঁদে উঠলো মর্মবেদনায়। পেয়ারা নবী শিশুটিকে বাড়ি নিয়েগেলেন। হযরত আয়েশা (রা.) ডেকে বললেন, ‘হে আয়েশা ঈদের দিনে তোমার জন্য একটি উপহার নিয়ে এসেছি। এই নাও তোমার উপহার’।

এতিম শিশুটিকে পেয়ে দারুণ খুশি হলেন। হযরত আয়েশা (রা.) দেরি না করে মুহূর্তেই শিশুটিকে গোসল করিয়ে জামা পড়ালেন, তারপর তাকে খেতে দিলে। নবীজি শিশুটিকে বললেন, ‘আজ থেকেই আমরাই তোমার পিতা মাতা’। কথাটি শুনে শিশুটি চোখেমুখে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। গল্পটি থেকে আমরা দেখতে পাই, এতিম শিশুর প্রতি রাসুল (স.) ভালোবাসার এক বিরল দৃষ্টান্ত। শিশু-কিশোরদের মন ফুলের মতো খুই নিষ্পাপ এবং সহজ সরল। মানবজাতিকে তিনি শিখাতে চেয়েছেন, শিশুদেরকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসাতে হয়। নবীজি শিশুদের স্নেহ ভালোবসাতেন নিজের সন্তানের ন্যায়। শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দানের কথা বলতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা শিশুসন্তানদের স্নেহ করো, তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করো এবং সদাচরণ ও শিষ্টাচার শিক্ষা দাও’ (তিরমিজি) তিনি আরো বলেন, ‘সন্তানদেরকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান খয়রাতের চেয়েও উত্তম। তোমাদের সন্তানদের উত্তররূপে জ্ঞানদান করো। কেননা তারা তোমাদের পরবর্তীযুগের জন্য সৃষ্ট’ (মুসলিম) পেয়ারা নবী সবসময় চাইতেন কোমলমতি শিশুরা যেন কোন সময় কষ্ট না পায় বা নির্যাতনের শিকার না হয়।

শিশুদের যে কোনো মৌলিক চাহিদা মেটাতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত যত্নশীল। কোনো শিশু দুষ্টুমি করলে তাকে কড়া শাসন না করে হাসিমুখে শোধরানোর কৌশল গ্রহণ করতেন। রাসুুলুল্লা (সা.) বলেছেন, ‘যে ছোটকে স্নেহমমতা করে না এবং বড়কে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়’ (বুখারি)। হযরত আনাস (রা.) বলেন ‘আমি রাসুসুল্লাহ (স.) ভালোবাসার চেয়ে আর কাউকে সন্তানের প্রতি এত অধিক স্নেহ নবীজি (সা.) প্রকাশ করতে দেখিনি’। নবীজি তাঁর কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত মা ফাতেমা কে খুবই স্নেহ করে প্রায়ই বলতেন ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা।

শিশু ফাতেমা যখন তাঁর কাছে যেতেন নবীজী তখন উঠে দাঁড়াতেন এবং ফাতেমার হাত ধরে চুমু দিয়ে তাকে মজলিসে বসাতেন। একবার মসজিদে খুতবা দেওয়ার সময় হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসাইন (রা.) লাল জামা পরিধান করে কম্পিত পায়ে নানার দিকে এগিয়ে এলেন। রাসুল করিম (সা.) তাদের দেখে স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি খুতবা স্থগিত রেখে তাদের কোলে তুলে সামনে এনে বসিয়ে তারপর খুতবা শুরু করলেন। নবীজি সফর থেকে ফেরার পর ছোট শিশুদের উটের সামনে পেছনে বসাতেন এবং তাদের সঙ্গে কৌতুক করে আনন্দ করতেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে শিশুদের প্রতি দয়া করে না, তাকে দয়া করা হয় না। (বুখারি, মুসলিম , তিরমিজি)

মহান সৃষ্টিকর্তার অপরূপা সৃষ্টিকুলের এক অনন্য নিদর্শন হলো বিহঙ্গ বা পাখি। সুবেহ সাদেকের সময় নানা প্রজাতির পাখি সৃষ্টিকর্তার প্রতি কলরবের মাধ্যেমে ইবাদত করে। সকাল সন্ধ্যায় মুক্ত আকাশে বিহঙ্গরা ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। বিহঙ্গ কিন্তু মানুষের উপকার করে। পরিবেশ প্রকৃতি ভারসম্য ও সৌন্দর্যের প্রতীক বলা যায় বিহঙ্গকে। বিহঙ্গ প্রজাতির কলকাকলি এবং গাছের ডালে পাখিদের আনন্দ মেলা দেখলে মানুষের মন আনন্দে পুলকিত হয় ।

একবার একজন সাহাবি একটি পাখির ছানা হাতে নিয়ে রাসুল(সা.) এর কাছে আসেন। পাখির ছানাটিকে দেখে মা পাখিটি তার চতুর্দিকে ঘুরতে লাগল। তখন পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বললেন, ‘যাও পাখির ছানাটি যেখানে ছিল সেখানে রেখে এসো।’
হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে তিনি বলেন, আমরা কোনো এক সফরে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সঙ্গে ছিলাম। এক জায়গায় একটি চড়–ই পাখিকে দুটি বাচ্চাসহ দেখতে পেলাম। আমরা বাচ্চা দুটিকে হাতে তুলে নিলাম। ফলে মা পাখিটি অস্থির হয়ে আমাদের মাথার ওপর ঘোরাঘুরি করতে লাগল। নবী করিম (সা.) বললেন, ‘বাচ্চা ছিনিয়ে নিয়ে কে তাকে কষ্ট দিয়েছে ? তাকে ফিরিয়ে দাও।’ (আবদু দাউদ)

বিশ্ব শান্তির দূত আমাদের প্রিয় মহানবী (সা.) ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে বিদায় হজ সম্পাদন করে মদিনায় ফিরে আসেন। হিজরি একাদশ বর্ষে (৬৩২ খিষ্টাব্দ) ৬৩ বছর বয়সে কয়েকদিন জ¦রভোগের পর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন সারাদু’জাহানের এক মহান উত্তম চরিত্র এবং তাঁর অনুসারীদের জন্য উত্তম আদর্শ। ‘লাখো সালাম! লাখো সালাম! লাখো সালাম! মোস্তফা জানে রহমত পে লাখো ছালাম, শাময়ে বজমে হেদায়াত পে লাখো সালাম।’

 

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট