চট্টগ্রাম শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সর্বশেষ:

বনবিভাগ চায় হাতি থাকুক, কেইপিজেড বলছে না
কেইপিজেডের পাহাড় ও জঙ্গলে বিচরণ করছে হাতি

বনবিভাগ চায় হাতি থাকুক, কেইপিজেড বলছে না

নাজিম মুহাম্মদ

২৮ আগস্ট, ২০২৫ | ১০:৫১ পূর্বাহ্ণ

আনোয়ারা কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হচ্ছে বারবার। হাতির দল আবাসস্থল ছেড়ে যেতে রাজি নয়। মাঝখানে চলে গেলেও গত ২০ জুলাই ফের ফিরে এসেছে তিনটি হাতি। হাতির চলাচল ও আবাসস্থল নিরাপদ করতে পুরো কেইপিজেড এলাকায় এলার্মযুক্ত ক্যামেরা লাগানোর স্থান নির্ধারণ করেছে বন বিভাগ। স্থান নির্ধারণের কাজও শেষের পথে। বনবিভাগ চায় হাতি শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করুক। কিন্তু কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ হাতি রাখতে কোনমতেই রাজি নন।

 

২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের উদ্যোগে জেলা প্রশাসককে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটির সচিব ছিলেন বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ। কমিটি ২০টি সুপারিশ দিয়েছিলো। যা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। এরমধ্যে হাতি সরিয়ে নিতে বন বিভাগকে দুই দফায় চিঠি দিয়েছে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ।

 

ডিএফও আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ জানান, হাতি আসার আগাম খবর জানতে ক্যামেরাযুক্ত সংকেতিক মেশিন বসানোর কাজ শেষের পথে। হাতি স্থানান্তর কখনো সম্ভব নয়। দেশে কিংবা বিদেশে এ ধরনের ঘটনা কখনো ঘটেনি। কিন্তু কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ হাতি রাখতে আন্তরিক নন। তারা পাহাড় এবং জঙ্গল কেটে কারখানা বাড়াচ্ছে। কিন্ত তাদেরকে জমি দেয়ার সময় পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়ে বেশ কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। যা মানা হচ্ছে না। এতে শুধু হাতি নয়। অন্য প্রাণীও বিলুপ্ত হচ্ছে। অথচ হাতি থাকলে তাদের সুনাম বাড়তো। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হলে বরং তাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হবে। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। আমরা চাই হাতি শান্তিপূর্ণভাবে সহঅবস্থানে থাকুক।

 

জানতে চাইলে কেইপিজেডের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুশফিকুর রহমান জানান, হাতির কারণে আমাদের চরম ক্ষতি হচ্ছে। সন্ধ্যা হলে কেউ বের হতে পারে না। শ্রমিকরা কারখানায় আসতে ভয় পাচ্ছে। হাতির দল সরিয়ে নিতে ইতিমধ্যে দুই দফায় বনবিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাহাড় ও জঙ্গল কেটে হাতির আবাসস্থল নষ্ট করা প্রসঙ্গে মুশফিক জানান, কেইপিজেড এলাকা কখনো জঙ্গল ছিলো না। আমরা বনায়ন করেছি। নতুন করে ৩০টি লেক খনন করেছি। এ এলাকা কখনো হাতির আবাসস্থল ছিলো না। চুনতি অভয়ারণ্য বনবিভাগ রক্ষা করতে পারেনি। যার কারণে হাতির দল এদিকে চলে আসছে। হাতি প্রতিরোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি হাতি ও মানুষের সংঘাত এড়াতে।

 

কমিটির মতামত: কমিটি তিন সপ্তাহের মাথায় ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেইপিজেড অব্যাহতভাবে বনাঞ্চল ও পাহাড় কেটে হাতির আবাসস্থল নষ্ট করছে। হাতি চলাচলের পথে যানবাহন ও বিভিন্ন পক্ষের লোকজনের আনাগোনা বেশি। হাতির খাবার দিন দিন কমে যাচ্ছে, মানুষ-হাতি সংঘাত কমাতে হাতি স্থানান্তর বিকল্প সমাধান নয়। বলা হয়েছে, কেইপিজেড একটি বিশ্বমানের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল। হাতির বিচরণের কারণে কেইপিজেডের কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। কেইপিজেড হাতিগুলোকে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করতে চায়। হাতি-মানুষ সংঘাতে বেশ কয়েকজনের প্রাণহানি ঘটেছে।

 

কেইপিজেড এলাকায় এবং আশেপাশে হাতির জন্য পর্যাপ্ত জল ছিল যেটি পুনরায় মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। ২০১৮ সালে এ এলাকায় দুটি হাতি ছিল। বর্তমানে পাঁচটি হাতি রয়েছে। হাতিগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক। হাতি নির্দিষ্ট পথ ব্যবহার করে অন্য জায়গা থেকে আসে। সুতরাং যদি স্থানান্তর করা হয় ফের হাতিগুলো ফেরত আসবে। গবেষণায় দেখা গেছে হাতি আবার সেই স্থানে ফিরে আসে যেখান থেকে তাদের ধরা হয়েছিল।

 

২০ সুপারিশ: হাতি মানুষ সংঘাত এড়াতে কমিটি স্বল্প মেয়াদে ১১, মধ্য মেয়াদে ৫ এবং দীর্ঘ মেয়াদে চারটিসহ ২০টি সুপারিশ করেছে। স্বল্পমেয়াদী সুপরিশে রয়েছে, প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের এক মাসের মধ্যে স্বল্পমেয়াদী হস্তক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। তা হলো, বন বিভাগ এবং স্থানীয় জন সাধারণের মধ্যে সমন্বয় থাকা, হাতিকে বিরক্ত না করা, কেইপিজেড এবং আশেপাশের এলাকায় হাতির গতিবিধি, অবস্থান ও পরিসংখ্যান বোঝা, পর্যবেক্ষণ চৌকি নির্মাণ করা, এসএমএস সতর্কতার জন্য মোবইল অ্যাপস তৈরি করা, কমপক্ষে ৫০টি ইআরটি গঠন, ইআরটির সরঞ্জাম যেমন- টর্চ লাইট, বাঁশি, পরিচয়পত্র ইত্যাদি, সচেতনতা বৃদ্ধি কার্যক্রম, হাতির ঘন ঘন বিচরণ এলাকা এড়িয়ে চলা, চলমান পাহাড় কাটা ও বন ধ্বংস বন্ধ করা, ধানের মৌসুমে ক্ষতি কমাতে হাতির অতিরিক্ত খাবার ব্যবস্থা করা। বন বিভাগ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে।

 

মধ্য মেয়াদী পাঁচ সুপারিশ প্রতিবেদন অনুমোদনের ছয়মাসের মধ্যে শুরু করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। তা হলো, হাতি-মানুষ সংঘাত নিরসনে কেইপিজেডের পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষা করা (যেমন ইনানী এবং হিমছড়িতে করা হয়েছে), কেইপিজেড এলাকা হাতির খাদ্য উপযোগী উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করা, হাতির পছন্দের খাদ্য উপযোগী গাছ রোপণ করা, এবং প্রকৃত সময়ের চলাচল জানতে হাতি কালার করা যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি। দীর্ঘ মেয়াদী চার সুপারিশ হলো, হাতির চলাচরের পথের সাম্ভাব্যতা যাচাই, হাতির বিচরণের উপর ভিত্তি করে চারপাশে ঘেরা দেয়া, হাতি বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে স্থানান্তরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, কারণ বাংলাদেশে অতীতে কখনো হাতি স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেনি এবং কেইপিজেডকে হাতিবান্ধব এলাকা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, যা সাফল্যের গল্প হিসাবে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হবে।

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট