চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর, ২০২৫

সীতাকুণ্ডে কারখানার তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে জনজীবনে সংকট
ফাইল ছবি

সীতাকুণ্ডে কারখানার তৃষ্ণা মেটাতে গিয়ে জনজীবনে সংকট

পূর্বকোণ রিপোর্ট

১১ আগস্ট, ২০২৫ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দীর্ঘ দিন ধরে মাটির নিচে নীরবে যে বিপর্যয় ঘটে আসছিল তা ক্রমশ প্রকাশ্য হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে নামতে সাধারণ নলকূপের নাগালের বাইরে চলে গেছে। স্থানীয় ভারী শিল্পকারখানাগুলোর মিষ্টি পানির চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভ থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি লিটার পানি তুলতে হচ্ছে। সেই পানির জোগান দিতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নলকূপগুলো পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে মানুষ গভীর নলকূপ বা সাবমার্সিবল পাম্প বসাচ্ছে। তাতে খরচ বাড়ছে কয়েকগুণ।

 

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, গভীরনলকূপ বা সাবমার্সিবল পাম্প বেশিরভাগের সামর্থ্যরে বাইরে। আর শিল্পকারখানার মালিকরা বলছেন, নদী থেকে পানি আনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প তাদের হাতে নেই। তারাও পানি সংকটের মধ্যে আছেন।

 

সীতাকুণ্ডের কারখানাগুলোর ৭৩ শতাংশ ভারীশিল্প। ইস্পাত, সিমেন্ট ও জাহাজ ভাঙা শিল্পে বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। এর পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি লিটার। তারা ভুগছে পানির সংকটে। খুঁজছে বিকল্প।

 

পানির চাহিদা ও প্রাপ্তি:
চট্টগ্রাম ওয়াসার তথ্য মতে, বন্দরনগরীর ৭৫ লাখ (সিটি করপোরেশনের হিসাবে ভাসমানসহ) বাসিন্দার ৯০ শতাংশকে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করা হয়। ওয়াসার দৈনিক পানি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ৫০ কোটি লিটার। কিন্তু উৎপাদন হয় দৈনিক ৪৮ থেকে ৪৯ কোটি লিটার। সেই হিসাবে জনপ্রতি পানি ব্যবহার করেন প্রায় ৬৪ লিটার।

 

সীতাকুণ্ড উপজেলার মোট জনসংখ্যা চার লাখ ৫৪ হাজার ৫১ জন। জনপ্রতি ৬৪ লিটার চাহিদা ধরলে পানি প্রয়োজন ২ কোটি ৯০ লাখ ৬০ হাজার লিটার। এই চাহিদার ঠিক কতটুকু পূরণ হচ্ছে তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও পানির জন্য সীতাকুণ্ডের অধিকাংশ মানুষের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।

 

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী প্রণবেশ মহাজন জানান, শুষ্ক মৌসুমে উপজেলায় ভূগর্ভস্থ পানির গড় স্থিতিতল দ্বিগুণের বেশি নিচে নেমে যায়। এতে ৩০০ ফুটের কম গভীরতার নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। তাই অধিকাংশ বাসিন্দাকেই নিকটস্থ গভীর নলকূপ বা সাবমার্সিবল থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।

 

সংকটে অধিবাসীরা:
উপজেলার বিভিন্ন এলাকার একাধিক নলকূপ স্থাপনকর্মী ও নলকূপ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কথা বলছেন তারা। নলকূপ ব্যবসায়ীরা জানান, যাদের সামর্থ্য আছে তারা সাবমার্সিবল পাম্প ও গভীর নলকূপের দিকে ঝুঁকছেন।

 

তাদের দাবি, পাঁচ থেকে ছয় বছর আগেও ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের যেসব যন্ত্র বিক্রি করতেন, তার ৯০ শতাংশই ছিল অগভীর নলকূপ। মাত্র ৫ থেকে ১০ হাজার টাকায় স্থাপন করা যায় বলে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই ছিল এটি। তবে আগে যেখানে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ১০০টি অগভীর নলকূপ বিক্রি করতেন সেখানে এখন এই ধরনের পানি উত্তোলন যন্ত্র বিক্রি প্রায় শূন্যের কোটায়। অগভীর নলকূপের বিকল্প হিসেবে এখন সাবমার্সিবল পাম্প ও গভীর নলক‚পের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। আর প্রতিটি সাবমার্সিবল পাম্প ও গভীর নলকূপের জন্য তাদের গুণতে হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। যা অধিকাংশ বাসিন্দারই নাগালের বাইরে।

 

৩৮ বছর ধরে সীতাকুণ্ড পৌরসভার ডিটি রোড এলাকায় হার্ডওয়্যার ব্যবসা করেন সীবলী হার্ডওয়্যার স্টোরস অ্যান্ড গ্যাস হাউসের মালিক পিজুস বড়ুয়া। পূর্বকোণকে তিনি বলেন, ‘তিন বছর আগেও সাধারণত নলকূপ আর জেড মটর ব্যবহার করতেন সাধারণ মানুষ। এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া যায় না টিউবয়েলে। ভূগর্ভে স্থাপিত পাইপে পানির গভীরতা ২৫ ফুটের নিচে চলে গেলে নলকূপ পানি উপরে নিয়ে আসতে পারে না।’

 

তিনি জানান, মানুষ এখন বাধ্য হয়ে সাবমার্সিবল পাম্প স্থাপন করছেন। এর খরচ নলকূপের চেয়ে পাঁচ থেকে দশগুণ বেশি। প্রতিটা সাবমার্সিবলের জন্য সাড়ে চারশ থেকে ছয়শ ফুট পর্যন্ত বোরিং (খনন) করতে হয়।

 

অথচ সীতাকুণ্ডের উত্তর-পূর্ব সীমান্তের উপজেলা ফটিকছড়িতে আরও কম বোরিংয়ে পানি মিলছে সাবমার্সিবলে। এই উপজেলার নারায়ণহাট এলাকার হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী নিজাম উদ্দিন বলেন, এটা সত্য কোথাও কোথাও এখন আর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তাই লোকজন নতুন করে সাবমার্সিবল স্থাপন করছেন। এই এলাকায় ৮০ থেকে দেড়শ ফুট বোরিং করে সাবমার্সিবলে পানি পাওয়া যাচ্ছে।

 

সমস্যার গভীরতা:
উপজেলায় সুপেয় পানি পেতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন উত্তর ভাটেরখীল, গুলিয়াখালী, সৈয়দপুর, ভাটিয়ারী, কুমিরা, মুরাদপুর ও গোপ্তাখালি এলাকার বাসিন্দারা। এসব এলাকার বাসিন্দারা জানান, শুষ্ক মৌসুম শুরুর পর থেকেই নিজেদের অগভীর নলকূপে পানি পান না তারা। সুপেয় পানির জন্য সাবমার্সিবল ও গভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে হয় তাদের। কিন্তু ব্যয়বহুল হওয়ায় গোটা গ্রামে সাবমার্সিবল ও গভীর নলকূপ স্থাপন করতে পারেন হাতে গোনা কয়েক পরিবার। অনেকক্ষেত্রে কয়েক গ্রাম মিলিয়ে এক পরিবারে সুপেয় পানির এই উৎস পাওয়া যায়। এতে ৫০০ মিটার থেকে ২ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের। আবার দিনের বেলায় পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে থাকায় অধিকাংশ সময় নারী ও শিশুদেরই পানি বহন করতে হয়। পানিভর্তি ভারী কলসি ও পাতিল বহন করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পড়ার কথাও বলছেন তারা। কোনো কোনো পরিবার বাধ্য হয়ে স্থানীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কিনে পানি ব্যবহার করছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কোনো কোনো দরিদ্র পরিবার সাবমার্সিবল স্থাপনের চিন্তা করছেন। যা তাদের নতুন করে আর্থিক সংকটে ফেলছে।

 

গেল তিন বছর ধরে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি না পেয়ে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহ করে উপজেলার উত্তর ভাটেরখীল এলাকার মো. আবু হানিফের পরিবার। মো. আবু হানিফ পূর্বকোণকে বলেন, ‘তিন থেকে চার বছর আগে সব ঠিক ছিল। নলকূপে পানি পাওয়া যেত। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে পানি পাই না। তাই বাধ্য হয়ে দূর থেকে পানি আনতে হয়। বাড়ির পুরুষরা তো সাধারণত কাজে থাকে, মহিলা ও বাচ্চাদেরই বেশিরভাগ সময় পানি আনতে হয়। যাদের টাকা আছে, তারা কিনে নেয়, কিন্তু আমরা তো কিনতে পারি না।’

 

স্থানীয়রা বলছেন, অনেক বাসিন্দা খাবার পানি ছাড়া দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি পুকুর-ডোবা, জলাশয় থেকে সংগ্রহ করে। সুপেয় পানির চাহিদা ঠিক কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও উপজেলার অধিকাংশ মানুষকে নিরাপদ খাবার পানির জন্য ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপরই নির্ভর করতে হয়। চাহিদার অর্ধেক পানি মিলছে এই উৎস থেকে। বাকিদের কেউ কেউ স্থানীয়ভাবে কেনা পানি ব্যবহার করেন। আবার কেউ বসতবাড়ির নিকটস্থ কৃষি জমিতে কূপ খনন করে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বলে জানিয়েছেন সাবেক উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নূর উদ্দিন রাশেদ।

 

স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় সুপেয় পানির ঘাটতি পূরণে জলাশয়ের পানি পনিশোধন করে ব্যবহার উপযোগী করার কথা বললেন স্থানীয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল কর্মকর্তা প্রণবেশ মহাজন। তিনি জানান, গৃহস্থলিতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে বিভিন্ন সময়। কিন্তু তা পর্যাপ্ত না। বাসিন্দাদের নিকটস্থ জলাশয়ের পানি পরিশোধন ছাড়া অন্য কোনো উপায় না পাওয়ার কথা বলছেন তিনি।

 

শিল্পযন্ত্রের পানির তৃষ্ণা:
স্থানীয় প্রশাসন ও উদ্যোক্তাদের তথ্য বলছে, সীতাকুণ্ডে সব মিলিয়ে কারখানার সংখ্যা ১৯৬টি। এরমধ্যে ৭৩ শতাংশ ভারী শিল্প। ভারী শিল্পের মধ্যে ৭৫টি জাহাজভাঙা এবং অন্তত ৪৩টি ইস্পাত কারখানা। এছাড়া আছে ৫ টি বস্ত্রকল, তিনটি সিমেন্ট, তিনটি গাড়ি সংযোজন ও যন্ত্রাংশ, নয়টি এলপি গ্যাস, ৪টি পেট্রোলিয়াম পরিশোধন এবং একটি করে টাইলস ও কাঁচ শিল্প কারখানা।

 

শিল্প উদ্যোক্তাদের তথ্যানুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ইস্পাত পণ্য তৈরি হয় ২৪ হাজার ৬৫৭ দশমিক ৫৩ টন। এর ৬০ শতাংশ অর্থাৎ ১৪ হাজার ৭৯৪ দশমিক ৫২ টন উৎপাদিত হয় সীতাকুণ্ডে। এরজন্যই প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি লিটার মিঠাপানির প্রয়োজন হয়।

 

উদ্যোক্তারা বলছেন, অন্যান্য ভারী শিল্প কারখানা মিলিয়ে প্রতিদিন আরও এক কোটি লিটারের বেশি মিঠাপানির প্রয়োজন হয় সীতাকুণ্ডে।

 

উৎপাদন অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনীয় এই মিঠাপানি দূরবর্তী নদী থেকে সংগ্রহ না করে সরাসরি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করে কারখানাগুলো। আর দীর্ঘদিন পানি উত্তোলনের কারণে নিচে নেমে গেছে পানির স্তর। অনেক কারখানা এখন প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তারাও ভূগর্ভস্থ পানির বিকল্প খোঁজছে। শিল্প কারখানায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিবেশকর্মীরা। তাদের আপত্তি এতো দিন কানে তোলেনি শিল্প মালিকরা।

 

ইস্পাত শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ)। সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ভ‚গর্ভস্থ পানি ব্যবহার ছাড়া কিছু করার নেই। কারণ দূরবর্তী নদী থেকে পানি নিয়ে আসা বেশ ব্যয়বহুল। এরজন্য বিশাল বিনিয়োগ প্রয়োজন। এই সক্ষমতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেই। এটা করা হলে পণ্যের দামে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে। তবে কোনো কোনো শিল্প কারখানা বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তাও করছে। এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরাও এখন ভ‚গর্ভস্থ পানি না পেয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। সীতাকুণ্ডর পাহাড় থেকে বিভিন্ন ছড়া হয়ে বৃষ্টির পানি সমুদ্রে যায়, আমরা ওই পানিটা সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। বলতে গেলে গত চার-পাঁচ বছর ধরে এটা করে আসছি। তবে পানির যে চাহিদা, এটা যথেষ্ট না।’

 

জাহাঙ্গীর আলমের পরামর্শ, ‘বৃহৎ পরিসরে মুহুরী প্রজেক্টের মতো সীতাকুÐের পাহাড়ি এলাকার ছড়াগুলোতে বাঁধ দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এটা করা গেলে শিল্পে ব্যবহারের পাশপাশি ভ‚গর্ভের পানির স্তরও আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আবার পাহাড়ি এলাকায় নৌপথ তৈরি হবে এবং তা ওই এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর যোগাযোগকে সহজ করবে।’

 

পরিবেশের ওপর প্রভাব ও প্রশাসনের নীরবতা:
ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে শিল্প ও মানুষের কাড়াকাড়িতে জনজীবনের পাশাপাশি সীতাকুণ্ড সংকটে পড়েছে পরিবেশও। শুষ্ক মৌসুমে খরায় নষ্ট হচ্ছে ফসল, কমছে ফলন। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। ধীরে ধীরে কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন তারা।

 

উপজেলার মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা শহীদুল আলম বলেন, ‘আগে পানির সমস্যা না থাকায় এলাকার সবাই বোরো আবাদ করতেন। কিন্তু গেল কয়েক বছর ধরে লোকসানের কারণে ফসলি মাঠ খালিই রেখে দিচ্ছেন কৃষরা।’

 

স্থানীয় এই বাসিন্দার কথার সত্যতা মেলে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসার কৃষি বিষয়ক প্রকল্প কর্মকর্তা সুমন দেবনাথের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে চাষ করে লোকসানে পড়ছেন কৃষকরা। ভূগর্ভস্থ পানি কমে যাওয়ায় শীতকালে দ্রুত কৃষি জমি শুকিয়ে যাচ্ছে, নলকূপেও পানি মিলছে না। বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করছেন কৃষকরা।’

 

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে পরিবেশের বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে শঙ্কা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের। তার মতে, নির্দিষ্ট কোনো এলাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেলে কৃষি উৎপাদন তো কমেই, পাশাপাশি মাটি থেকে পানি না পেয়ে ওই এলাকার গাছপালার সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। যা পরিবেশের ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 

দেশে সরকারি সংস্থা হিসেবে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাই যে কোনো কারখানা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয় সংশ্লিষ্টদের। সীতাকুণ্ডের এসব কারখানাও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয় সত্তে¡ও ভ‚গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের বিষয়ে কারখানাগুলোকে পরিবেশ অধিদপ্তর বা অন্য কোনো সংস্থার বাধার মুখে পড়তে হয় না।

 

এই বিষয়ে আইনি দুর্বলতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অধিদপ্তরটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন। তার দাবি, পরিবেশ অধিদপ্তর কেবল বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণ নিয়ে কাজ করে।

 

সম্ভাব্য সমাধান বা করণীয়:
শিল্পোৎপাদনে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃত্রিম জলাধার সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হতে পারে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এক্ষেত্রে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে হিতে বিপরীত হয় কিনা সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়ার পরামর্শ তাদের।

 

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ড. ফারজানা রহমান জুথী বলেন, ‘ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে কারখানায় ব্যবহৃত পানি পরিশোধনের মাধ্যমে পুনঃব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে জলাধার সৃষ্টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প হতে পারে। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা যাবে না। এর কারণে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, বন্যা হতে পারে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সেদিকে নজর রাখতে হবে।’

 

তিনি বলেন, ‘সবদিক নিয়ে যথাযথ স্টাডি করে যদি এটা করা যায়, তাহলে কিছুটা হলেও সুফল মিলবে। আবার এটাকেও পুরোপুরি টেকসই বলা যাবে না, কারণ বছরের সব সময় বৃষ্টি এক রকম থাকে না, একেক বছর একেক রকম বৃষ্টি হয়, সেসবও মাথায় রাখতে হবে।’

 

পবার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াহেদও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে কৃত্রিম জলাশয় তৈরির বিষয়ে ইতিবাচক মত দেন। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির যে পানি সমুদ্রে চলে যায়, সেটা সংরক্ষণ করে যদি কারখানাগুলোর চাহিদা মেটানো যায়, সেটা ইতিবাচকই হবে। তবে পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ নষ্ট হলে জলজ বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হতে পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।’

 

তার পরামর্শ, ওই এলাকায় এই কৃত্রিম জলাশয়ের কারণে বন্যার শঙ্কা আছে কিনা তাও দেখতে হবে। অনেকটা স্লুইসগেটের মতো ব্যবস্থা করা যেতে পারে, যেন বাড়তি পানি বের করে দেওয়া যায়।

 

সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলামের মতেও বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে কৃত্রিম জলাশয় সৃষ্টি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে কৃত্রিম জলাশয় সৃষ্টিতে উপজেলা প্রশাসন সহযোগিতা করবে বলে জানান তিনি।

 

কিন্তু শিল্পে পুরোপুরি ভূপৃষ্টের পানি ব্যবহারের পরামর্শ চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলমের। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ আপাতত একটা বিকল্প হতে পারে। কিন্তু শিল্প কারখানা তো ক্রমবর্ধমান। এটা টেকসই হবে না। সীতাকুণ্ডে জলাশয় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সেসবের পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। ভূগর্ভের পানি শিল্পে ব্যবহার না করে ভূপৃষ্টের পানিই ব্যবহার করতে হবে।’

 

পূর্বকোণ/ইবনুর

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট