স্বাধীনতার স্মৃতিবিজরিত পার্বত্য খাগড়াছড়ির তৎকালীন মংরাজা মংপ্রু সাইন বাহাদুর ছিলেন একজন শাসক ও সম্মুখ সারির মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাক-বাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতায় ভারতগামী মুক্তিযোদ্ধোদের চিকিৎসা ও সহায়তায় রাজ ভাণ্ডার খুলে দিয়েছিলেন।
প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র হাতে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীকে ৩৩টি উন্নতমানের অস্ত্র ও ১১০০ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ৯ মাস প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পেয়ে মরার সৌভাগ্য হয়নি!
স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও রাষ্ট্রীয় সম্মান বা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত না হওয়ায় পরিবারে জমে থাকা বেদনা ও দুঃখ যেন ক্রমেই ভারী হচ্ছে। প্রয়াতের দৌহিত্র রাজা মংপ্রু সাইন বাহাদুর ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কুমার সুইচিংপ্রুসহ রাজ পরিবারের আশা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার অবশ্যই এই জাতীয় বীরের মর্যাদা দিবে।
উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সফিউল আলম চৌধুরী জানান, ৫ম মংরাজা মংপ্রু সেইন ৪৪ বছর বয়সে তাঁর মা রাণী নানুমার মৃত্যুর পর ১৯৫৪ সালে রাজত্ব পান। তাঁর জন্ম ১৯১০ সালের ১০ নভেম্বর। মাত্র ২ বছর বয়সে পিতা কোংগলাকে হারিয়ে মায়ের আদরে বেড়ে উঠেন মংপ্রু সাইন।
তাঁর মা নানুমা দেবী হলটিকে হাসপাতাল বানিয়ে আহত মানুষকে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন। মুক্তিবাহিনীর সাথে মহালছড়িতে পাকবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন রাজা মংপ্রু সাইন। এক পর্যায়ে মানিকছড়ি ও মহকুমা শহর রামগড় পতনের আশংকায় সিংহাসন ও ধন-সম্পদের মায়া ত্যাগ করে ১৯৭১ সালের ১ মে সপরিবারে ভারতের হরিণা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ভারতে আশ্রয় নিয়ে আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমে পাকবাহিনীর ভয়াবহতার তথ্য বিনিময় করেন রাজা মংপ্রু সাইন। এক পর্যায়ে দেশে ফিরে কুমিল্লা-আখাউড়া এলাকায় দীর্ঘসময় সশস্ত্র ও সম্মু যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এদিকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরা রাজ প্রসাদে তাণ্ডব চালিয়ে অস্ত্রাগার ও মাটিতে পুঁতে রাখা স্বর্ণালংকার লুট, হাসপাতালে হামলাসহ পুরো রাজপ্রসাদ লণ্ডভণ্ড করে দেয়। পরে দেশ স্বাধীন হলে রাজা সপরিবারে দেশে ফিরে আসলেও অক্ষত পাননি রাজপ্রসাদ! দেশমাতৃকার মায়ায় হারানোর শোক ভুলে গিয়ে রাজত্ব শুরু করেন। এক পর্যায়ে রাজা মংপ্রু সেইন খাগড়াছড়ির গর্ভনর হিসেবেও নিয়োগ পান। রাজ্যভার পালনকালে ১৯৮৪ সালে পরলোকগমন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মংপ্রু সাইন বাহাদুর।
উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শফিউল আলম চৌধুরী বলেন, মংরাজা মংপ্রু সাইন একজন সম্মুখসারির যুদ্ধাই নন, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তিনি তাঁর গাড়ি-বাড়ি (রাজপ্রসাদ), অস্ত্রশস্ত্র, বৈদেশিক মুদ্রা (ডলার) ও পুরো রাজবাড়িকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প বানিয়ে দিয়েছেন।
এছাড়া ভারতে যাতায়াতে সকল নাগরিকদের সাময়িক বিশ্রাম, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রহানিতে অর্জিত পতাকা আমরা পেলেও রাজা মংপ্রু সেইন এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি না পাওয়ায় আমরা লজ্জিত ও মর্মাহত।
পূর্বকোণ/ইব