ঘড়ির কাটায় তখন সকাল নয়টা। প্রতিটি বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে কারো একটি-দু’টি কলসি, কারো তিন থেকে পাঁচটি গ্যালন। কারো আবার বড় বড় ড্রাম। কবে আসবে সুপেয় পানি সরবরাহকারী গাড়ি- সেই অপেক্ষায় আড়ালে মুখ লুকানো অগণিত গৃহিণী। সমুদ্র ঘেরা দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার কৈয়ারবিল ও লেমশীখালী ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের নিত্যদিনের চিত্র এটি।
উপজেলার বড়ঘোপের কলেজ গেটস্থ একটি নলকূপই এ দুই ইউনিয়নের অন্তত ২০ থেকে ২৫ গ্রামের মানুষের সুপেয় পানির ভরসা। ডজনখানেক ভ্যান ও টেম্পু চালক ওই নলকূপ থেকে পানি সরবরাহ করে বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের তৃষ্ণা মেটায়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য মতে, দীর্ঘদিনের স্থাপিত প্রায় ৫ হাজারের অধিক নলকূপ থাকলেও সুপেয় পানির সংকট দূরীকরণে সরকারিভাবে ২০১৯/২০ থেকে ২০২৪/২৫ অর্থ বছরে লেমশীখালী ২২৬টি ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নে ১৯৯টি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এলাকাভেদে প্রতিটি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে ৮’শ থেকে ১২’শ ফুট গভীরে। কিন্তু কোনোটি তেমন কাজে আসেনি। এর ৯৫ শতাংশ নলক‚পের পানি লবণাক্ত।
গত টানা ৩/৪ দিন সরেজমিনে দুই ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ছাদ খোলা টেম্পুগাড়ি ও অটোরিকশা যোগে ঘরে ঘরে খাবার পানি পৌঁছে দেয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। রীতিমতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে প্লাস্টিকের গ্যালন ও বড় বড় ড্রাম ভর্তি সুপেয় পানি সরবরাহকারী গাড়ি এসে হর্ন বাজায় বাড়ির সামনে। হৈ-হুল্লোড় করে কেউ ১/২ দিনের জন্য আবার কেউ পুরো সপ্তাহের জন্য খাবার পানি সংগ্রহ করে। এভাবেই চরম দুর্ভোগে বছরের পর বছর অতিক্রম করছে তারা।
দক্ষিণ লেমশীখালী শাহাজির পাড়া, বশির উল্লাহ সিকদার পাড়া ও ছিদ্দিক হাজির পাড়াসহ ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকাবাসীর মতে, শেষ কবে নলকূপের পানি দিয়ে স্নান করেছে তা জানা নেই কারো। একটু বিলাসিতা তো দূরের কথা, কাল পানি ওয়ালা আসবে কিনা! সেই দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করে অনেক গৃহিণী। ৫০ লিটার পানি ভর্তি প্রতি গ্যালনের দাম ধরা হয় ৩০/৪০ টাকা। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ ঝড় বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ করে বেড়ে ওঠা হাজার হাজার পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী খাবার পানি বাবদ প্রতি মাসে খরচ গুণতে হয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। শুষ্ক মৌসুমে কোনো রকম, তবে বর্ষায় কাঁচা রাস্তা দিয়ে কোনো কোনো জায়গায় গাড়িযোগে পানি সরবরাহ বন্ধ থাকে। এতে নিরুপায় হয়ে পুকুর কিংবা বৃষ্টির পানি দিয়ে তৃষ্ণা মেটায় শত শত পরিবার।
স্থানীয়দের অনেকেই আক্ষেপ নিয়ে আঞ্চলিকে জানায়, ও বাপ পানির দেশত পয়দা হইলেও ’ আঁরার পানির দুঃখ বারো মাস’।
লেমশীখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ আকতার হোছাইন বলেন, কুতুবদিয়া দ্বীপের জন্মলগ্ন থেকে ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকায় নলকূপে পানি ওঠে না। যুগ যুগ ধরে উপজেলা থেকে পানি কিনে এনে খায়। সরকারিসহ স্থানীয় প্রশাসন ও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। সবই লবণাক্ত, তবে কি কারণে সুপেয় পানি মিলছে না- এর সঠিক কোনো কারণ জানা নেই। পরিষদের পাশে নির্মিত একটি প্রকল্প থেকে প্রায় ৬’শ পরিবার আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সুপেয় পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারলেও আরো প্রায় ১১’শ পরিবার ওই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে, উপজেলার মধ্যবর্তী কৈয়ারবিলেরও একই দশা। পুরো ইউনিয়নজুড়ে মাত্র ২/১ টি নলকূপে সুপেয় পানির দেখা মিলে। তাও মুহূর্তেই রূপ বদলায়। কিবা রাত্রি, কিবা দিন! হাতের চাপে বেশিরভাগ সময় লবণাক্ত পানি উঠে। প্রতিদিন বড়ঘোপের তারা ভবন ও কলেজ গেটস্থ গভীর নলকূপ থেকে কেউ নিজস্ব রিকশাযোগে আবার কেউ কেউ পানি সরবরাহকারী বা ভ্যানচালকদের নিকট বছরের পর বছর পানি কিনে নেয়। বিশেষ করে আজম সড়কের পূর্বপাশে কৈলস্যাঘোনা ও মলম চরবাসীর যেন ভোগান্তির শেষ নেই।
স্থানীয় ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান শফিউল আলম বলেন, ইউনিয়নের ৯০ শতাংশ জায়গা সুপেয় পানিশূন্য বললেই চলে। গভীর-অগভীর সব নলকূপের পানি লবণাক্ত। এখন বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে নির্মিত একটি প্রকল্প থেকে পানি সরবরাহের জন্য দু’টি ওয়ার্ডে পাইপ লাইন দেয়া হচ্ছে। তবে অন্যান্য ওয়ার্ডের হাজার হাজার মানুষ এ প্রকল্পের সুফল পাবে না।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মো. ফরহাদ মিয়া বলেন, কুতুবদিয়া একটা কোস্টাল এরিয়া। এখানে লবণাক্ত পানির আধিক্য বেশি। দ্বীপের চতুর্দিকে লবণাক্ত পানির আগ্রাসন, কৃষি কাজ ও লবণ উৎপাদনের জন্য পাম্প মেশিনের মাধ্যমে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানির স্তরগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট এবং লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিগত ৭/৮ বছরে উপকূলীয় এ অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির স্তর ১’শ থেকে দেড়শ ফুট নিচে নেমেছে। কোথাও কোথাও একেবারে পাওয়া যায় না। সুপেয় পানির পরিমাণটা নির্দিষ্ট। অপরিকল্পিত ভূগর্ভের পানি দিয়ে চাষবাসের কারণে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হয়ত কুতুবদিয়াবাসীর জন্য সুপেয় পানির সমস্যাটি একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক সংকট হয়ে দাঁড়াবে। গভীর নলকূপ স্থাপন করেও সুফল পাবে না স্থানীয়রা।
তিনি আরো বলেন, সুপেয় পানির সমস্যা দূরীকরণে উপজেলার লেমশীখালী, কৈয়ারবিল, দক্ষিণ ধুরুং ও বড়ঘোপ ইউনিয়নে চারটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। যেখান থেকে পাইপ টু ওয়াটার স্কিমের মাধ্যমে ওই চার ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার পরিবার সুপেয় পানির ঘাটতি পূরণ করতে পারবে। তাছাড়া লবণ পানি পরিশুদ্ধ ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে সুপেয় পানি সাপ্লাইয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় ডিসেলাইনেশন প্লান্ট এর কাজ চলছে।
পূর্বকোণ/ইব