চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

আতঙ্কের নাম রাউজান, ৭ মাসে ৬ জন খুন

নিজস্ব প্রতিবেদক

২২ মার্চ, ২০২৫ | ১২:৩৩ অপরাহ্ণ

খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ভূমি, বালু মহাল দখল, আধিপত্য নিয়ে মারামারি, চুরি, ডাকাতি, জোরপূর্বক অন্যের জমি ও পুকুরের মাটি কেটে ব্যবসা, বিএনপির দু’পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে সংঘর্ষ- কি হচ্ছে না এখন রাউজানে। এ উপজেলায় এখন রাতের অপরাধতো বটেই, প্রকাশ্য দিবালোকেও ঘটছে খুন, চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। মাঝে শান্তির জনপদে পরিণত হওয়া সেই রাউজান এখন আবারো পরিচিতি পাচ্ছে সন্ত্রাসের জনপদে। তারই বড় জ্বলন্ত উদাহরণ ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া গত ৭ মাসের কম ব্যবধানে ৬ খুন এবং ৫০-৫৫টি হামলা এবং চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং নানা অপরাধের ঘটনা।

 

রাউজান এখন এক আতংকের নাম। প্রায় প্রতিদিনই উপজেলার ১৪ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার কোন না কোন এলাকায় ঘটছে নানান অপরাধের ঘটনা। মূলত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর রাউজানে নতুন করে বিস্তার ঘটেছে অপরাধের। বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন ঘটছে কোন না কোন অপরাধের ঘটনা।

 

জানা যায়, হত্যাকাণ্ড ছাড়াও চাঁদাবাজি, বালুমহাল দখল ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত আট মাসে সংঘর্ষ, হামলা এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৫০-৬০টি। এসব ঘটনায় অনেকে গুলিবিদ্ধ, ছুরিকাঘাত ও বিভিন্নভাবে গুরুতর আহত হয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশংকাজনক ছিল। কারো কারো অঙ্গ ক্ষতও হয়েছে। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ব গুজরার হোয়ারাপাড়ায় গণপিটুনিতে নিহত হন মো. রুবেল নামের এক যুবক। এর আগে নোয়াজিষপুরের ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধ, একজনকে ছুরিকাঘাতসহ ১৩-১৪ জন আহত এবং ৭টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৮ মাসে সংঘটিত ঘটনার বেশিরভাগই বিএনপির দুই গ্রুপে দ্বন্দ্বের জেরে ঘটেছে।

 

জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এবছরের ২০ মার্চ পর্যন্ত ৮ মাসে রাউজানে সংঘর্ষ, হামলা ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫০টি। আহত হয়েছেন ৩ শতাধিকের বেশি। এরমধ্যে ২৫-৩০টি ঘটনাই ঘটেছে উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে উপজেলায় গত ৭ মাসে খুন হয়েছেন ৬ জন। নোয়াপাড়া ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি দু’জন খুন হয়। এছাড়া নোয়াজিষপুর, কদলপুর, উরকিরচর, পূর্ব গুজরা, পাহাড়তলী, রাউজান সদর, পশ্চিম গুজরা, হলদিয়া, ডাবুয়া ইউনিয়নে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ-মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বিএনপি নেতা থেকে শুরু করে যুবদল, ছাত্রদল ও অন্য অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৫০-৫৫ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ শতাধিকের বেশি।

 

জানা যায়, সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ব গুজরার হোয়ারাপাড়ায় গণপিটুনিতে নিহত হন মো. রুবেল নামের এক যুবক। ১৫ মার্চ রাতে বিএনপির দুই গ্রুপের আধিপত্যের জেরে হলদিয়ায় যুবদলকর্মী কমর উদ্দীনকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চৌধুরীহাটে সন্ত্রাসীরা মুহাম্মদ হাসান (৩৫) নামের এক যুবলীগ নেতাকে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে অটোরিকশায় লাশ ফেলে যায়। এর আগে ২৪ জানুয়ারি মসজিদে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে শুঁটকি ব্যবসায়ী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে। এছাড়া গত বছরের ২৯ আগস্ট রাঙামাটি জেলার কাউখালীর শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নানকে (২৭) রাউজানে এনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই বছরেরই ১ সেপ্টেম্বর রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ.বি.এম ফজলে করিম চৌধুরীর বাগানবাড়ি থেকে এক কৃষি শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার নাম মুহাম্মদ ইউসুফ মিয়া (৫৫)। ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীরা গুলিবিদ্ধ করে ঝাঝরা করে দেয় উত্তরজেলা যুবদল নেতা পেয়ার মোহাম্মদ চৌধুরী বাবুকে।

 

এছাড়াও ২ ডিসেম্বর সোমবার রাত সাড়ে ১১টার রাউজানে জানিপাথর বাজারে মোটরসাইকেল উদ্ধার করতে গিয়ে বিএনপি কর্মীর নেতৃত্বে দুষ্কৃতকারীর হামলায় এক এসআইসহ তিন পুলিশ আহত হয়েছেন। গত ৫ ডিসেম্বর মামুন রাউজানে চাঁদা না দেয়ায় এবং কেন্দ্রীয় বিএনপির গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী সমর্থক হওয়ায় ডেকোরেশন মালিকসহ ৫ জনকে মেরে আহত ও দোকান লুটপাট এবং মোটরসাইকেল, মোবাইল ছিনতাই করা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বর শনিবার রাতে রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের আশরাফ আলী চৌধুরী হাট প্রকাশ সোমবাইজ্জ্যা হাটে আনোয়ার হোসেন বাচলু (৩৮) নামে এক যুবদল নেতাকে গুলি করে আহত করা হয়, ২৫ ডিসেম্বর বুধবার রাতে কদলপুর ইউনিয়নের আশরাফ শাহ (রা.) মাজার গেটের সামনে গাছের গাড়ি ছিনিয়ে নিতে দুর্বৃত্তের ছোড়া গুলিতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়, তারা হচ্ছে জামাল উদ্দিন (৫৫), বাগোয়ানের গশ্চি গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে মো. মামুন (৩২), আবুল হোসেনের ছেলে মাহবুব আলম (৩০)।

 

২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম নগরী থেকে তুলে নিয়ে রাউজান পৌরসভা যুবলীগের সহ-সভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীকে অপহরণ এবং ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ উঠেছে। অপহৃত আরিফুল হক রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়াহেদেরখীল গ্রামের মোজাম্মেল হকের ছেলে। সাংবাদিকদের কাছে অপহরণের অভিযোগটি করেছেন অপহৃতের স্ত্রী সৈয়দা হালিমা বেগম ও ছোট ভাই সাদ্দাম হোসেন চৌধুরী, ৪ জানুয়ারি শনিবার রাউজানের নোয়াপাড়া পথেরহাটে কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক সাংসদ গিয়াস উদ্দীন কাদের চৌধুরীর জনসভা থেকে ফেরার পথে সন্ত্রাসী হামলায় ৪-৫ জন বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের কর্মীকে মারধর করা হয়েছে হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এরমধ্যে একজনকে মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয়। ৭ জানুয়ারি রাউজানে দিনদুপুরে ১টি গাভী চুরির ঘটনা ঘটেছে।

 

চুরি হয়ে যাওয়া গাভীর মূল্য প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা বলে জানায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, ১২ জানুয়ারি রাউজানের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের বদুমুন্সি পাড়ার এক গৃহস্তের প্রায় দেড়লাখ টাকা দামের দুটি গরু গোয়াল থেকে চুরি করে নিয়ে যায় চোর, ১৭ জানুয়ারি রাউজানের নোয়াজিষপুরে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জেরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক গ্রুপের শাহাদাত হোসেন শিমুল (২৪) নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে দক্ষিণ নোয়াপাড়া এলাকার কাতারপ্রবাসী খলিলুর রহমান খোকনের নতুন বাড়িতে দুর্ধর্ষ চুরি সংঘটিত হয়, ২৪ জানুয়ারি রাউজানে খাদ্য রপ্তানি ও আমদানি কাজে নিয়োজিত এক সেলসম্যানকে মারধরের পর নাকে এক ধরণের পদার্থ দিয়ে অজ্ঞান করে ব্যাগভর্তি ৮০ হাজার টাকা নিয়ে গেছে প্রাইভেটকারধারী ছিনতাইকারীরা।

 

আহত মো. সোহেল (২৭) নামের যুবকটি রাউজান সদরের ইজিফুডের সেলসম্যান, ১৬ ফেব্রুয়ারি রবিবার রাত রাউজানের নোয়াপাড়া পথেরহাট থেকে এক ব্যবসায়ীকে চাঁদার জন্য তুলে নিয়ে প্রায় একঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেয় অপরণকারীরা। আলহাজ এস. এম. শফি নামের এই ব্যবসায়ী পথেরহাটস্থ ‘ফুলকলি’ শাখার মালিক এবং নোয়াপাড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক, ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ (৪২) নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়, ৬ মার্চ দক্ষিণ নোয়াপাড়ায় কাতার প্রবাসী হাজি কাশেম প্রকাশ এহছানের ঘরে র্দ্ধুর্ষ চুরি সংঘটিত হয়, সম্প্রতি ডাকাতি হয় আধার মানিক গ্রামের এক পরিবারে। গত বুধবার নোয়াজিষপুরের ইফতার মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন গুলিবিদ্ধ, একজনকে ছুরিকাঘাতসহ ১৩-১৪ জন আহত এবং ৭টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাউজান সদরের বাসিন্দা সিআইপি খোরশেদ জামান অভিযোগ করেন, আমি প্রবাসে থাকার সুযোগে কোন রকম সম্পত্তি বিরোধ ছাড়াই আমার পুকুর ও জায়গা ভরাট এবং দেয়াল নির্মাণ করে দখল করার চেষ্টা করছে সন্ত্রাসীরা।

 

এদিকে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র জানায়, উপজেলায় চাঁদা আদায়ের জন্য অপহরণ, পরে মুক্তি, রাজৈনিতক দ্বন্দ্বে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে অসংখ্য। এছাড়া পিটিয়ে জখম, জায়গা-বালু মহাল দখলসহ নানা ঘটনাও ঘটছে অহরহ। নোয়াপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি, সাধারণ জনগণের জমির মাটিকাটা, পুকুরকাটার ঘটনা ঘটছেই। এসবের মধ্যে কিছু কিছু ঘটনায় মামলা হলেও বেশিরভাগ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি।

 

রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, নিয়মিত অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এরমধ্যে সন্ত্রাসী মামুনসহ অনেককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ দিনরাত কাজ করছে। ইতিমধ্যে বেশি ‘অপরাধ জোন’ নোয়াপাড়ার পুলিশ ক্যাম্পে পুনরায় পুলিশ ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

 

পূর্বকোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট