তারু মিয়ার জন্ম ১৯৪১ সালের ৭ জুলাই। মো. তারু মিয়া ১৯ বছর বয়সে যোগদান করেন আর্মি সার্ভিস কোরে। প্রশিক্ষণের জন্য তাকে নেওয়া হয় পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। সেখানে সেনাবাহিনীর মটর পরিবহন (এমটি) বিভাগে প্রশিক্ষণের পর তৎকালীন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানীর ব্যক্তিগত গাড়ি চালক ছিলেন তারু মিয়া।
রাওয়াল পিন্ডিতে জেনারেল ওসমানী তখন ছিলেন কর্নেল পদে। পাকিস্তানে ৬ বছর চাকরি করার পর বাংলাদেশ ফিরে এসে যোগ দেন ৪ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। এরপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। একান্ত আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধের কথা মনে করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা তারু মিয়া বর্তমানে বসবাস করেন বান্দরবান শহরের পৌরসভা কার্যালয় সংলগ্ন এলাকায়। তার মূল বাড়ি কুমিল্লার সদর উপজেলার উজিরপুর গ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বীর মুক্তিযোদ্ধা তারু মিয়া বলেন, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ছয় বছর চাকরির পর ১৯৭১ সালে তিনিসহ আরো ৪০ জন সৈনিক বাংলাদেশে ফিরে এসে যোগদেন পুরনো প্রতিষ্ঠান ৪ ইস্টবেঙ্গলে। তিনি ছিলেন তখন নায়ক সুবেদার। ছিলেন কুমিল্লায় সেনানিবাসে। এদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের তীব্র আন্দোলন শুরু হয়ে যায় চারদিকে। তখন সৈনিকরাও বসে থাকতে পারেনি। তখনকার আর্মি অফিসার ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি ও ক্যাপ্টেন গাফ্ফার সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পরিস্থিতি বুঝে সৈনিকদের পাঠিয়ে দেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায়। সেখানে ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ।
তীব্র আন্দোলনের মাঝে পাকিস্তানি অফিসার ক্যাপ্টেন গাফফারসহ ৫/৬ অফিসারকে সৈনিকরা ঘিরে ফেলেন। সে সময় পাকিস্তানি বাহিনী ভৈরবে ২ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে হামলা করলে সৈনিকরা আরো উত্তাল হয়ে ওঠেন। পরে তারু মিয়াসহ অন্যান্য সৈনিকরা ছত্রভঙ্গ হয়ে সিলেট হয়ে ঢুকে পড়েন ভারতে। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা মেঘালয় রাজ্যের মেলাঘর এলাকায় খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে সেখানে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। বাংলাদেশ থেকে শত শত তরুণরা যোগ দেয় প্রশিক্ষণে। তারু মিয়া সহ আরো অনেকে ওই ক্যাম্পে তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন।
প্রায় দেড় মাস পর মে মাসের দিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গড়ে তুলেন জেড ফোর্স নামের একটি বাহিনী। এতে যোগ দেন বেশ কয়েকটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা। অন্য সবার সঙ্গে বাছাই করা হয় সৈনিক তারু মিয়াকেও। তিনি সে সময় যোগ দেন ৮ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে। এই জেড ফোর্সে সবার পোশাক আলাদা ছিল। ভারতের মাটি থেকে জেড ফোর্সের সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকে অপারেশন চালাতো। মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তারু মিয়ার নেতৃত্বে এক প্লাটুন সৈনিক অপারেশনের জন্য ঢুকে পড়েন সিলেট সীমান্তের তেল ঢালা এলাকায়।
দিনটি ছিল ১৩ ডিসেম্বর। হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছে সীমান্তের কাছের একটি গ্রামে। নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে। অপারেশনের আগে ভালো করে দেখে শুনে ভোরের আলো ফোটার আগে অপারেশনে নেমে পড়েন তারু মিয়াসহ অন্যান্য সৈনিকরা। কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে পুরো দলটি বিপদে পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীদের সামনে। দু পক্ষের গোলাগুলিতে দলটির অধিনায়ক সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এমদাদুল হক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সাথে আরো ৬ সৈনিক। কিন্তু গোলাগুলি তখনও বন্ধ হয়নি। কর্দমাক্ত মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে চালিয়ে যান গুলি।
তারু মিয়া ভাবছিলেন জীবন এখানেই শেষ। তখন মনে পড়ছিল তার পরিবারের কথা। মায়ের কথা। দেশের স্বাধীনতার কথা। তবে বীর সৈনিকদের প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদাররা পিছু হটে ওই গ্রাম থেকে। পরে শহীদদের লাশ নিয়ে আসা হয় সেখান থেকে। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এমদাদুল হককে উপাধি দেওয়া হয় বীর উত্তম খেতাব। যুদ্ধের পর তারু মিয়া আবারো যোগ দেন ৪ ইস্টবেঙ্গলে। আশির দশকে চাকরির সুবাদে বান্দরবানে চলে আসেন তারু মিয়া। পরে তাকে সম্মানের সঙ্গে অনারারি ক্যাপ্টেন পাদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
তারু মিয়া বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি যখন গ্রামে ফিরে যান সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা তার জেড ফোর্সের পোশাক দেখে তাকে পাকিস্তানি সৈনিক মনে করেছিলেন। অনেক নির্যাতন করেছিল তারা। তবে সঠিক পরিচয় পাওয়ার পর সম্মান দেখায়।
পূর্বকোণ/ইব