বীর মুক্তিযোদ্ধা রতন দাশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে বলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আমার বড় ভাই, ভাইয়ের স্ত্রীসহ রাউজান নোয়াপাড়া গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। আমার মা-বাবা শহরের বাসায় থেকে যান। নোয়াপাড়ায় আমাদের বাড়িটা জ্বালিয়ে দেওয়ার পর সবাই ওখান থেকে হেঁটে মাদার্শা হয়ে ফতেয়াবাদ আমার মাসীর বাড়িতে চলে যাই।
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে আমি ও বড়ভাই ভারতের দিকে রওনা হলাম। বিবিরহাট দিয়ে যাবার পথে পাঞ্জাবিরা আমাদের ধরে নিয়ে যায়। বিবিরহাট পুলিশ ফাঁড়িতে দাঁড় করিয়ে রাখে। আমি এবং আমার ভাইসহ সাতজনকে তারা দাঁড় করিয়ে রাখে। পরে এক বেলুচি আর্মি এসে আমাদের দেখতে পায়। সে আমাদের জিজ্ঞাসা করল বাড়ি কোথায়? তখন আমরা জবাব দিলাম এই কাঞ্চননগরে। তখন ওই বেলুচি আর্মি আমিসহ সাতজনের মধ্যে ছয়জনকে ছেড়ে দেয়, একজনকে ধরে রাখে। আমরা দুইভাই কাঞ্চননগর হয়ে রামগড়ের দিকে রওনা হলাম এবং রাজা মনমোহনের রাজবাড়িতে পৌঁছলাম। ঐখানে রাত্রিযাপন করে সকালে দুইভাই সন্ধ্যায় রামগড় পৌঁছি।
তখন রামগড় স্কুলে ইপিআরের (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) ক্যাম্প হয়েছে। ক্যাম্পে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যাচ্ছি। সেখানে তাদের সঙ্গে আমরা তিনদিন ছিলাম। পরদিন আমরা ইপিআর সেনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খাল পার হয়ে দ্রুত সাব্রুম চলে যাই। সাব্রুমে রিফিউজি ক্যাম্পে তিনদিন থাকার পর আমি উদয়পুর আর্মি ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের জন্য উপস্থিত হই। এই ক্যাম্পে ১৫ দিন গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার পর ক্যাম্পের মেজর বলবীর সিং আমাদের বললেন, ‘তুমহারা ট্রেনিং খতম হুয়া। আভি তোমলোক ইস্ট পাকিস্তানমে চলা যাও’। পরে আমরা আগরতলা চলে যাই।
পরে আমরা দুই ভাই (অপরজন আমার বড় ভাই গৌরাঙ্গ) সাব্রুম ফিরে যাই। সেখানে আরো তিনজন ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওরা হলো কাঞ্চননগরের আছলাম, জব্বার ও নাঈম। আমরা পাঁচজন খাল পার হয়ে উপরে ওঠার সময় একটি গাড়ির আওয়াজ শুনে দ্রুত জঙ্গলে ঢুকে পড়ি। সন্ধ্যায় রাজা মনমোহনের রাজবাড়িতে আশ্রয় নিই এবং পরদিন চট্টগ্রাম শহরে আমার বাসায় চলে আসি। শহরে কোতোয়ালীর ৮ নম্বর গ্রুপ কমান্ডার এস.এম মাহবুব-উল-আলমের বাড়ি ও আমার বাড়ি পাশাপাশি। তাঁর সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত বলার পর তিনি বললেন, ‘তুই আমার গ্রুপের সঙ্গে অপারেশনে থাকবি’।
অক্টোবরের মাঝামাঝি একদিন সন্ধ্যায় রাজাকার কমান্ডার হামিদুল হক (খোকা) কিছু পাঞ্জাবি আর্মি নিয়ে ঘাটফরহাদবেগ বরোদা কুটিরে হানা দেয়। তখন আমার কাছে থাকা দুটি হ্যান্ড গ্রেনেডের একটি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বরোদা কুটিরের দিকে ছুঁড়ে মারি। গ্রেনেডটা বিস্ফোরিত না হওয়ায় খোকা ও পাক আর্মিরা বেঁচে যায়। পরদিন রাস্তা থেকে পাঞ্জাবিরা আমাকে ধরে মিউনিসিপ্যাল অফিসের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায়।
ঘাটফরহাদবেগে একটি অবাঙালি পরিবার বাস করতো। সেই পরিবারে চারজন ছেলে ছিল। আমার বাবা বুদ্ধি খাটিয়ে ঐ পরিবারের একজন ছেলেকে মিউনিসিপ্যাল অফিসের আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যান। ছেলেটি ক্যাম্পে ঢোকার পর ওখানে বসে থাকা একজন পাঞ্জাবি লোক তাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে, ‘আত্তুভাই তোম কেছাহে’। আত্তুভাই উত্তর দিল, ‘হাম আচ্ছা হে’।
এরপর আত্তুভাই আমাকে মিউনিসিপ্যাল অফিস থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। তখন আমার মাথা থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। পরে আমার বাবা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান এবং হাসপাতালে কয়েকদিনের চিকিৎসায় মাথায় সাতটি সেলাই হওয়ার পর বাসায় নিয়ে আসেন। পরে আমার নিরাপত্তার জন্য বাবা ঐ আত্তুভাইয়ের বাসায় আমার রাতে থাকার ব্যবস্থা করেন। আমি ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর কোতোয়ালী থানাধীন ৮ নম্বর গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব ভাইয়ের সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করি।
পূর্বকোণ/ইব