কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (কেইপিজেড) বিদেশি নাগরিকসহ প্রায় ৩৩ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মস্থল। প্রতিদিন রাতে কোরিয়ান ইপিজেড এলাকায় হানা দিচ্ছে বন্যহাতির পাল। যার ফলে সন্ধ্যায় কারখানা ছুটি হলে আতঙ্কে থাকেন শ্রমিক-কর্মচারীরা। রাতে আতঙ্কে ভুগেন নৈশপ্রহরীরা।
গত ১০ বছরে হাতির আক্রমণে ১৬ জন মারা যায়। আতঙ্কে রাত কাটান কেইপিজেডের আশেপাশের এলাকার মানুষ। ইতোমধ্যে কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ কর্মচারীদের নিরাপত্তা, এবং এলাকাবাসীর জান-মালের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক চিঠি দিলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের মধ্যেই বন বিভাগের কাজ সীমাবদ্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের বাঁশখালী জলদী রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ।
কেইপিজেড সিকিউরিটি দপ্তর সূত্র জানায়, সর্বপ্রথম ২০১২ সালের ১ মার্চ শাহ মীরপুরের জুয়েল দাশ (১৩), ১৮ সালের ১৩ জুলাই মুহাম্মদপুরের আবদুর রহমান (৭০), একই বছর ১৮ আগস্ট বটতলা বারখাইনের আবদুল মোতালেব (৬৮), ৩১ অক্টোবর বড় উঠানের জালাল আহমদ (৭০), ২০১৯ সালের ২৬ জুন বটতলী গুচ্ছগ্রামের মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৪ জুলাই বৈরাগের আক্তার হোসেন (৫০), ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি বটতলীর মো. সোলাইমান (৭০), ৩ ফেব্রুয়ারি গুয়াপঞ্চকের দেবী রানি দে (৪০), ২০ ফেব্রুয়ারি শাহ মিরপুরের মায়া বড়ুয়া (৭০), ২০২১ সালের ১১ অক্টোবর গুয়াপঞ্চকের অজ্ঞাত (৫০), ২০২৩ সালের ৬ জুলাই বারখাইনের ছাবের আহমদ (জুনু) (৭০), ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর দৌলতপুরের সৈয়দ আহমদ (লুতু মিয়া) (৫০), ২৩ সেপ্টেম্বর গুয়াপঞ্চকের মো. কাশেম (দুলাল) (৬০), এদিন একই এলাকার রেহেনা বেগম (৩৫), ২১ অক্টোবর বটতলীর হালিমা খাতুন (৬৫), ২৩ অক্টোবর বড় উঠানের মো. আকবার (৩৮) এর মৃত্যু হয়।
কেইপিজেড সূত্রে জানা যায়, আনোয়ারা-কর্ণফুলী উপজেলার ওই এলাকায় বর্তমানে ৪৭টি কারখানায় প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের অনেককে হেঁটে কারখানায় যাতায়াত করতে হয়। এ সময় তারা হাতির ভয়ে থাকেন। পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া হাতির পাল ইতোমধ্যে কেইপিজেডের গাছপালা ও বিভিন্ন স্থাপনাসহ প্রায় ২ কোটি টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। দায়িত্বরত বিদেশি নাগরিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক ও নিরাপত্তা প্রহরীরাও ভুগছেন আতঙ্কে। ইতোমধ্যে হাতির আক্রমণে পার্শ্ববর্তী গ্রামের প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছে শতাধিক।
প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের ঘর ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে। হাতির পাল যেকোনো সময়ে কোরিয়ান ইপিজেডের কারখানায় আক্রমণ করে ক্ষতিসাধন করতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে। সর্বশেষ দায়িত্বরত অবস্থায় মরিয়ম আশ্রম এলাকায় গত শুক্রবার মো.হাকিম নামের এক সিকিউরিটি গার্ডের ওপর হামলা করে বন্যহাতির দল। আহত সিকিউরিটি গার্ডের বাড়ি আনোয়ারা উপজেলার চাতরী গ্রামে। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানান তার পরিবার।
এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর কেইপিজেডের গলফ কোর্সে হাতির আক্রমণে ডি হাং কং নামে বাংলাদেশে কোরিয়ান ন্যাশনালের একজন বিনিয়োগকারী গুরুতর আহত হয়। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহ মীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে গত ৬ বছর ধরে তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও শত শত একর ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বন্যহাতির তাণ্ডবে।
কেএসআইয়ের এক নারীশ্রমিক বলেন, ছুটি শেষে বাসায় ফেরার সময় ভয়ে ভয়ে যেতে হয়। না জানি কখন হাতি চলে আসে। দীর্ঘদিন ধরে হাতির এ তাণ্ডব চললেও প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। রাতের বেলায়ও শঙ্কায় থাকি কখন বাড়িতে হাতির পাল হানা দিচ্ছে।
এসব দাবির পেক্ষিতে কেইপিজেড কর্পোরেশন (বিডি) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কর্নেল (অব.) মহোম্মদ শাহজাহান বলেন, স্বয়ং কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ হাতিগুলো তাড়ানোর বিষয়ে অনেক আগে থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে লেখালেখি করে আসছে। যার ফলে হাতিগুলো তাড়ানোর বিষয়ে ২০২২ সালে ৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দেয়। কিন্তু আজও এর কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আরেকটি কমিটি এসে কেইপিজেড পরিদর্শন করে যায়। কেইপিজেডের পক্ষ থেকে বেতন দিয়ে এআরটি টিম রাখা হয়েছে।
এছাড়া হাতিগুলোর কারণে কেইপিজেডের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বিনিয়োগকারীরাও ভয়ে আছে। তাই এটা কেইপিজেডের জন্যও বড় ক্ষতিকারক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সরকার উদ্যোগ নিলে হাতি অপসারণে সব ধরনের সহযোগিতা কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বন বিভাগের বাঁশখালী জলদী রেঞ্জ কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ বলেন, হাতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবগত আছেন। হাতির বিষয়ে সরেজমিনে তদারকি করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। হাতির আক্রমণে হতাহতদের এবং ক্ষতিগ্রস্তদের বন বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয় বলে জানান তিনি।
আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার বলেন, আমি আনোয়ারায় আসার পর হাতির বিষয়ে শুনেছি, তবে বিস্তারিত জানি না। গতকাল একজন আহত হওয়ার খবর পেয়েছি সেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হবে।
পূর্বকোণ/ইব