একেবারেই অরক্ষিত রাতের হালদা। তাতে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে মা মাছ শিকারীরা। এমনকি রাতে হালদায় অভিযান চালাতে গিয়ে মাছ শিকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন প্রশাসনের অভিযান টিমের সদস্যরাও।
গত ১৪ নভেম্বর মধ্যরাতে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে অভিযান করতে যায় হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টিম। অভিযানে আরও ছিলেন হাটহাজারী উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার, গ্রাম পুলিশ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফ’র (ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন) বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। এ সময় প্রশাসনের অভিযান দল আইডিএফ’র একটি স্পিডবোট ব্যবহার করে।
অভিযান দলের সদস্যরা হালদা নদী থেকে ১০টি অবৈধ জাল জব্দ করে ফেরার পথে রাত তিনটার দিকে রাউজানের খলিফার ঘোনা এলাকায় হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা তাদের উপর ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে। তাতে গুরুতর আহত হন গ্রাম পুলিশের মো. ফজলুল করিম আদিল। আরও আহত হন আইডিএফ’র স্পিডবোট চালকও। তাদের সবাইকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতার কথা বলে চাকরি ছেড়ে দেন আইডিএফ’র স্পিডবোট চালক।
এ নিয়ে হাটহাজারী থানায় একটি অভিযোগও দেন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম। তবে এখনও হামলাকারীদের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এছাড়া এ ঘটনার পর রাতে অভিযান বন্ধ করে দেয় উপজেলা মৎস্য অফিস। গত এক মাসে তারা হালদায় দিনের বেলায় মাত্র দুটি অভিযান চালাতে সক্ষম হয়।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য অফিসার শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, জেলা বা উপজেলা মৎস্য অফিসের কাছে কোন স্পিডবোট নেই। তাই আইডিএফ’র স্পিডবোটের সাহায্যে আমাদের অভিযান চালাতে হয়। গত ১৪ নভেম্বর হালদায় রাতের অভিযানে হামলার পর মৎস্য বিভাগ দিনে দুটি অভিযান চালায়। তাতে বিপুল পরিমাণের অবৈধ জাল জব্দ করা হয়। ওইদিনের ঘটনার পর আইডিএফ’র স্পিডবোট চালক ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। তাই আমরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া নিয়ে অভিযান চালাই।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মো. আমিনুল ইসলাম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, গত ১৪ নভেম্বর হালদায় অভিযানে অবৈধ মা মাছ শিকারীদের হামলার পর হাটহাজারী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে যে, ঘটনাটি রাউজানের খলিফার ঘোনা এলাকায় হয়েছে। তাই এখন রাউজান থানায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করবো।
হালদার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সাল থেকে হালদায় মা মাছ রক্ষাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কাজ করে আসছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইডিএফ (ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন)। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহযোগিতায় ইফাদ ফেইজ প্রকল্পের আওতায় হালদায় রেণু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মাটির ক‚য়া তৈরিতে উদ্বুদ্ধকরণ ও সরঞ্জাম প্রদান, নদীর উজানে মানিকছড়িতে তামাকচাষ বন্ধ, নদীর তীরবর্তী জমিতে কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার, বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ, নদী নিয়ে গবেষণা, সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে।
এমনকি তাদের সহায়তায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় একটি হালদা ল্যাবও। তাছাড়া নদীতে অবৈধ মা মাছ শিকারীদের পাকড়াও করতে একটি স্পিডবোট ও একটি শব্দহীন সোলার বোটও ব্যবহার করে। তাতে ব্যবহার করা হতো তাদের ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবকও। তাদের সহায়তায় হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য অফিস হালদায় রাতে ও দিনে সমানে অভিযান চালায়। তাতে অনেকটা বন্ধ হয়ে যায় মা মাছ শিকারীদের তৎপরতা। কিন্তু কিছুদিন আগে আইডিএফ তাদের কার্যক্রম একটু কমিয়ে দিলে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মা মাছ শিকারীরা। এমনকি তারা প্রশাসনের অভিযান টিমের উপর হামলা করার মতো ঔদ্ধত্য দেখায়।
এ প্রসঙ্গে আইডিএফ’র নির্বাহী পরিচালক জহিরুল আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, হালদার ক্রমাগত মা মাছ শিকার বন্ধের জন্য প্রকল্পের আওতায় আইডিএফ নদীর পাড়ে রাউজান ও হাটহাজারীতে ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়। তাদের বাহন হিসেবে দেওয়া হয় একটি করে স্পিডবোট ও সোলার বোট। এ যান দুটির সাহায্যে রাত-দিন সমানে হালদায় পাহারা দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। স্পিডবোট অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও দ্রুত অভিযানের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। বর্তমানে পিকেএসএফ’র সহযোগিতা ছাড়া হালদায় কাজ করছে আইডিএফ। তাতে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও হালদায় অভিযানে প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে আইডিএফ।
জানতে চাইলে আইডিএফের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অধ্যাপক শহীদুল আমিন চৌধুরী বলেন, গত ১৪ নভেম্বর হালদায় অভিযানে অবৈধ মা মাছ শিকারীদের হামলার শিকার হয়ে ভয়ে চাকরি ছেড়ে দেন আইডিএফ’র স্পিডবোট চালক। বর্তমানে নতুন করে একজন স্পিডবোট চালক খুঁজছি। চালক পাওয়া গেলে পুনরায় হালদায় অভিযানে সহযোগিতা দেওয়া হবে।
পূর্বকোণ/ইব