দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের ৫৬২ কোটি টাকার কাজ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কাজের টেন্ডার পাওয়া ঠিকাদারদের বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতা। ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর অনেকেই আত্মগোপনে। এতে প্রকল্পের কাজ নিয়ে উদ্বিগ্ন পাউবোর কর্মকর্তারা।
২০২৩ সালের ১৮ জুলাই সন্দ্বীপ সুরক্ষায় ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৬২ কোটি ২১ লাখ টাকার প্রকল্প একনেক সভায় পাস হয়। ১৭ প্যাকেজে ভাগ করে কাজের টেন্ডার দেওয়া হয়।
পাউবো সূত্র জানায়, টেন্ডার পাওয়া চার ঠিকাদারের মধ্যে অর্ধেক কাজ পেয়েছে বিশ্বাস বিল্ডার্স। ১৭ প্যাকেজের কাজের মধ্যে আট প্যাকেজের কাজ পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। ৫৬২ কোটি টাকার প্রকল্পে বিশ্বাস বিল্ডার্স পায় অন্তত ৩২৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক নজরুল ইসলাম (দুলাল) ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সন্দ্বীপ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কাজ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পাউবোর কর্মকর্তারাও সুবিধা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমএম বিল্ডার্স নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে দুই প্যাকেজের কাজ পেয়েছে রয়েল এসোসিয়েট। প্রতিষ্ঠানটি পটিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর যুবলীগ নেতা দিদারুল আলমের মালিকানাধীন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটিও অন্তত এক শ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আওয়ামী লীগের এই দুই প্রতিনিধি। তাই তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এছাড়াও কাজ পেয়েছে খুলনা শিপ ইয়ার্ড, ই-ইঞ্জিনিয়ার নামে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এই দুটি প্রতিষ্ঠান ছোট আকারের ৭ প্যাকেজের কাজ পেয়েছে। আর মেসার্স হাসান এন্ড ব্রাদার্স ও জামান ব্রাদার্স নামে দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মাটির বাঁধ নির্মাণের কাজ পেয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, অনেকটা প্রতিযোগিতা ছাড়াই টেন্ডার পেয়েছে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ দুই ঠিকাদার।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী খ ম জুলফিকার তারেক পূর্বকোণকে বলেন, ‘ সন্দ্বীপ চর এলাকা হওয়ায় অনেকেই যেতে চায় না। যারা টেন্ডার দিয়েছে, তাদের সবাই কাজ পেয়েছে।’
প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের দুই নেতা। প্রায় সোয়া ৪শ কোটি টাকার বেশি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্ববধায়ক প্রকৌশলী জুলফিকার তারেক বলেন, ‘লাইসেন্সে ক্যাপাসিটি অনুযায়ী দরপত্রে অংশ নেওয়া যায়। যার লাইসেন্সে যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি রয়েছে, সেভাবে কাজ পেয়েছেন।’
প্রকল্প অনুমোদনের ১৬ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজ শুরু করা যায়নি। দ্বীপের চারদিকে চর জেগে ওঠায় নির্মাণসাগ্রী ও যন্ত্রপাতি নেওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদাররা।
তবে পূর্বকোণের সন্দ্বীপ সংবাদদাতা সরেজমিন ঘুরে জানান, সারিকাইত ইউনিয়নের বাংলাবাজার ঘাটের দক্ষিণাংশ, মুছাপুর সুইস গেট এলাকা, রহমতপুর ঘাট ও গুপ্তচরা ঘাট এলাকার ঘাট দিয়ে স্থানীয় নির্মাণসামগ্রী ব্যবসায়ীরা ভারী পণ্য ওঠানামা করে। কাঠের তৈরি বড় বোট ও মাঝারি আকারের ভলগেট দিয়ে পণ্য ওঠানো হচ্ছে। এছাড়াও জোয়ারের সময় ভারী পণ্য ওঠানো-নামাতে কোনো ধরনের বিঘ্ন ঘটছে না বলেও জানান তিনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর-২ বিভাগ) ড. তানজির সাইফ আহমদ বলেন, ‘জানুয়ারি ও মার্চ মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। চরের চারদিকে অস্বাভাবিকভাবে চর জেগে ওঠা ও খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নির্মাণসামগ্রী এবং যন্ত্রপাতি নিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবে বর্তমানে দু-একজন ঠিকাদার মালামাল নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি।
দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দুই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় পূর্বকোণের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা চর জেগে ওঠার কারণে মালামাল নিতে পারছেন না বলে দাবি করেন। একজন বলেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর এলাকার রাজনৈতিক মেরুকরণও পরিবর্তন হয়েছে। আগে আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। এখন বিএনপির লোকজনদের ম্যানেজ করে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা মালামাল সরবরাহের জন্য যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছেন। এছাড়াও বড় সংকট হচ্ছে ব্যাংক ঋণ ও ব্যাংকের তারুল্য সংকট। ঠিকাদাররা আত্মগোপনে থাকায় ব্যাংক ঋণ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্পে ১২.৩৪ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ২টি নতুন সুইস গেট নির্মাণ করা হবে। ৭টি পুরনো সুইস গেট মেরামত করা হবে।
পূর্বকোণ/এমিটি