চট্টগ্রাম সোমবার, ০১ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

হালদায় অশনি সংকেত

মোহাম্মদ আলী

২৯ জুন, ২০২৪ | ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ

এক সপ্তাহের ব্যবধানে হালদা নদীতে মারা গেছে ৪টি রুই জাতীয় মা মাছ ও একটি ডলফিন। বিশেষজ্ঞদের প্রাথমিক ধারণা, মূলত চার কারণে প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদায় এ অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

 

কারণগুলো হচ্ছে- নদীদূষণ, মাছ শিকারের জন্য বিষ প্রয়োগ, রাবার ড্যামে জমে থাকা রাসায়নিক ও কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি এবং মা মাছ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। এজন্য আরও স্বচ্ছ ধারণা নিতে মাঠপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায়ে বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে তদন্ত টিম গঠনেরও দাবি উঠেছে।

 

হালদা নদীর হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের কুমারখালী এলাকা থেকে গতকাল শুক্রবার দুটি কাতল ব্রুড মাছ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটির ওজন ১০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৫৮ সেন্টিমিটার, অপরটির ওজন সাড়ে ১২ কেজি। এটির দৈর্ঘ্য ৯৮ সেন্টিমিটার।

 

১০ কেজি ওজনের মাছটি পচে যাওয়ায় মাটিচাপা দেওয়া হয়। মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণের জন্য ১২ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের কাতল মাছটি হাটহাজারী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

জানা যায়, গত ২৬ জুন হালদা নদীর রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের বাকর আলী চৌধুরী ঘাট এলাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি মা রুই মাছ মরে ভেসে ওঠে। পরে স্থানীয়রা এটি উদ্ধার করে মাটিচাপা দেয়। এটি উদ্ধারের কয়েকদিন আগে আরও একটি ১২ কেজি ওজনের মরা কাতল নদীতে ভেসে এলে সেটিও ডাঙায় তুলে মাটিচাপা দেয় স্থানীয়রা।

 

তাছাড়া গত ২৬ জুন হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের সিপাহীরঘাট এলাকা থেকে নদীতে ভাসমান অবস্থায় একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়। এটি উদ্ধার করে ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (আইডিএফ) কর্মীরা। এ নিয়ে গত সাড়ে পাঁচ বছরে হালদা থেকে ৪১টি মৃত ডলফিন উদ্ধার হয়। এর আগে সর্বশেষ ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর হালদা নদী থেকে একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছিল।

 

হালদার স্বেচ্ছাসেবী রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা মুহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, নদীতে আগে যান্ত্রিক নৌযানের পাখার আঘাতে ডলফিন ও মা মাছ মরে ভেসে উঠতো। এখন ভেসে ওঠা মা মাছ ও ডলফিনে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত নদীর হাটহাজারী অংশে যে ৪টি খাল হয়ে নগরীর বিভিন্ন কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য হালদা নদীতে পড়ছে, এসবের বিষক্রিয়ায় মা মাছ ও ডলফিন মারা যেতে পারে। হালদার ডিম সংগ্রহকারী হাটহাজারীর গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নতুনহাট এলাকার বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিন সওদাগর দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, হালদা নদীর শাখা খালের মুখে স্লুইচ গেট এলাকায় কিছু কুম রয়েছে। এসব এলাকায় বিষ ঢেলে মাছ শিকার করে অসাধু ব্যক্তিরা। খালে ফেলা এসব বিষ নদীকে দূষণ করছে। ফলে মা মাছ মৃত্যুর মুখে পড়ছে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৭ মে হালদায় সীমিত আকারে ডিম ছাড়ে মা মাছ। তাতে প্রায় ২০০ নৌকা নিয়ে হালদায় ডিম সংগ্রহ করেন আহরণকারীরা। পরে তা পরিচর্যা করে আহরণকারীরা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি রেণু পান। অথচ আগের বছর ২০২৩ সালে রেণু পাওয়া যায় প্রায় ৪৩৭ কেজি। স্বাভাবিকভাবে ডিম সংগ্রহকারীরা আশা করেছিলেন পরবর্তী ‘জো’গুলোতে আরও ডিম পাওয়া যাবে। কিন্তু গত ২৫ জুন ডিম দেওয়ার সর্বশেষ ‘জো’ ভরা পূর্ণিমা শেষ হয়ে গেলে আশাহত হন ডিম সংগ্রহকারীরা।

 

হালদা বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, ডিম দেওয়ার দু’দিন আগে হালদা নদীর ফটিকছড়ির ভ‚জপুর ও হারুয়ালছড়ি এলাকার দুই রাবার ড্যামের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে রাবার ড্যামে ৬ মাস ধরে জমে থাকা রাসায়নিক ও কেমিক্যাল হালদা নদীর পানির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তাতে ৭ মে মা মাছ নদীতে স্বাভাবিক পরিবেশ না পেয়ে ডিম ছাড়েনি। তাছাড়া মা মাছ নদীতে পুরো ডিম ছেড়ে দিতে না পারলে প্রাকৃতিকভাবে এগুলো নিজ শরীরে ধারণ করে ফেলে। কিন্তু পানির গুণাগুণ ও পরিবেশগত কোন সমস্যা থাকলে এ শারীরবৃত্তীয় কাজটি সম্পন্ন করার সময় অনেকক্ষেত্রে মা মাছ জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীতে বিগত দুই বছর পরে কয়েকদিনের ব্যবধানে চারটি ব্রুড মাছ এবং একটি ডলফিনের মৃত্যু একটি অস্বাভাবিক ঘটনা। আরও একটি হতাশাজনক বিষয় ২০১৬ সালের পর হালদা নদীতে এ বছর সবচেয়ে কম পরিমাণ ডিম দিয়েছে, যা পরিমাণে নমুনা ডিমের চেয়ে একটু বেশি।

 

তিনি বলেন, শাখা খালসমূহের দূষণের কারণে পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বিষ প্রয়োগে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রাথমিকভাবে অন্যতম কারণ বলে মনে করি। তবে হালদা নদী রক্ষার জন্য বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এই বিপর্যয় রোধে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে কারণ উদঘাটনের দাবি জানাচ্ছি।

 

তিনি আরও বলেন, তাছাড়া সর্তা খালের উজানে ছিপাতলী, তেলপারই খালের মুখ, পেশকারহাট এলাকায় পেশাদার বড়শি দিয়ে মাছ ধরার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব এলাকায় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে প্রশাসনিক নজরদারি বাড়াতে হবে।

পূর্বকোণ/এসএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট