চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কধুরখীল, চরণদ্বীপ ও খরণদ্বীপ এলাকা ধরে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষে গেলেই দেখা যায়, সারি সারি বালু বিক্রির হাট। ড্রেজার-ভলগেট ও ট্রাক-ডাম্পারে বালু উঠা-নামায় শ্রমিকদের নিদারুণ ব্যস্ততা। এই তিন ইউনিয়নে অন্তত অর্ধ শতাধিক বালু বিক্রির হাট গড়ে ওঠেছে নদীর তীরে।
জেলা প্রশাসনের বালুমহালের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী অংশে সরকারি তালিকাভুক্ত কোনো বালুমহাল নেই। তারপরও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও বেচাকেনা। স্থানীয় প্রশাসন মাঝে-মধ্যে অভিযান চালিয়ে বালু উত্তোলন ও বিক্রির হাট বন্ধ করে। কিন্তু রহস্যজনকভাবে ফের চালু হয় অবৈধ বালু উত্তোলন ও বেচাকেনা।
শুধু বোয়ালখালী নয়, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় কর্ণফুলী নদী থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবাধে চলে আসছে অবৈধ উত্তোলন ও বেচাকেনা। অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে নদী ভাঙন বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা। সরকারি দলের প্রভাবশালীরা ক্ষমতার দাপটে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বোয়ালখালী আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদের শোকসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা প্রশাসনের নথি বলছে, চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার নদ-নদী থেকে ৫০টি বালুমহাল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরমধ্যে কর্ণফুলী নদীতে রয়েছে মাত্র তিনটি বালুমহাল। একটি হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার ফকিরাঘাট বালুমহাল। আর দুটি হচ্ছে রাউজানের কর্ণফুলী বালুমহাল (নোয়াপাড়া ও বাগোয়ান মৌজা)।
বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব পূর্বকোণকে বলেন, বোয়ালখালীতে বৈধ কোনো বালুমহাল নেই। ফলে রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। এই বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হবে। বালুমহাল ইজারা দেওয়া হলে সরকার রাজস্ব পাবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা জানান, পানি প্রবাহ স্বাভাবিক রাখা ও ভাঙন প্রতিরোধে পরিকল্পিতভাবে নদী ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু বালুখেকোরা নদী ও নদীর তীর থেকে ড্রেজার দিয়ে অপরিকল্পিত ও যত্রতত্রভাবে বালু উত্তোলনের কারণে বর্ষাকাল ছাড়াও সারাবছর নদী ভাঙন লেগে রয়েছে। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার উন্নয়নযজ্ঞ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে কর্ণফুলী নদীর ভাঙনরোধ ও ড্রেজিং কাজের জন্য ৩৯৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পে কর্ণফুলী ছাড়াও ইছামতি নদীও ছিল। কিন্তু ইছামতি নদীর ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি পাউবো। এতে প্রায় ৯৭ কোটি টাকার কাজ অবাস্তবায়িত থেকে যায়। বর্তমানে ভাঙনরোধে নতুন করে প্রায় শত কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। নদীর যত্রতত্র স্থান থেকে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনে শত শত কোটি টাকার এসব প্রকল্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
পাউবোর প্রকৌশলীরা জানান, নদীর চর বা তলদেশ থেকে বালু কাটার কোনো জ্ঞান না থাকায় যেনতেনভাবে বালু উত্তোলনে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বোয়ালখালী, রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ার ত্রি-সীমানায় নদীর বুকে রয়েছে নাজির চর। নাজির চরকে ঘিরে চারদিকে চর জেগে ওঠেছে। প্রতিদিন অন্তত ৩০টি ড্রেজার ও লোডিং-আনলোডিং মেশিনে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। চরের তীর ঘেঁষে বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার কারণে ১০-১২ বছর ধরে নাজির চরের ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে বলে জানান স্থানীয়রা।
বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক চিহ্নিত বা নির্ধারিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচ, খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে নির্মিত জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ বা নদী ভাঙনরোধকল্পে নির্মিত পরিকাঠামো বা অবকাঠামো সংলগ্ন এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করা যাবে না।’ তবে আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে।’
বালু বাণিজ্যের হাট : বোয়ালখালীর কধুরখীল, চরণদ্বীপ ও খরণদ্বীপ ইউনিয়ন বালু বাণিজ্যের নিরাপদ জোনে পরিণত হয়েছে। তিন ইউনিয়নে নদীর তীরে অন্তত ৪০টি বালু বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সবকটি বিক্রয়কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করছে সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বালু উত্তোলন ও বেচাকেনায় জড়িত রয়েছেন বোয়ালখালী, রাউজান ও রাঙ্গুনীয়ার সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। নদী থেকে ড্রেজার ও ভলগেট দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করে আসছে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। ১০-১৫ জন নেতা সরাসরি নদী থেকে বালু উত্তোলন করেন। তাদের কাছ থেকে কিনে বিক্রি করেন আরও ৫০ জন নেতাকর্মী।
এই বিষয়ে কথা হয় একাধিক বালু ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তারা জানান, ‘বন্দর জলসীমানার বাইরে কধুরখীল চৌধুরী হাট থেকে জ্যৈষ্ঠপুরা ও রাঙ্গুনিয়া সীমানার চিরিয়া পর্যন্ত একসময় বালুমহাল ইজারা ছিল। বালুমহাল খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসনের অধীনে আসার পর ইজারা বন্ধ হয়ে যায়। ইজারা বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন।
টোকেনে চলে বালুবাহী গাড়ি: কর্ণফুলী নদীর বালুর ভালো চাহিদা রয়েছে। বোয়ালখালী ছাড়াও পটিয়া, আনোয়ারা, চন্দনাইশসহ বিভিন্ন উপজেলা এবং নগরের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। অন্তত ৫ শতাধিক ট্রাক ও ডাম্পার বালু পরিবহন করে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নির্বিঘেœ চলাচল করছে এসব যানবাহন। ট্রাক ও ডাম্পারগুলোকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকার বিনিময়ে পুলিশ থেকে টোকেন নিতে হয়।
অভিযান নিয়ে প্রশ্ন: গত মাসে বোয়ালখালীর বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু বিক্রয়কেন্দ্র ও বালু পরিবহনে ট্রাক-ডাম্পারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে স্থানীয় প্রশাসন। প্রশাসনের অভিযানের অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ডাম্পারকে জরিমানা করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কিছু কিছু বিক্রয়কেন্দ্র চালু হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বালু ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে প্রভাবশালীরা পুনরায় বালু উত্তোলন ও বেচাকেনা শুরু করেছে। অন্যরা এখনো দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে।
এই বিষয়ে বোয়ালখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব বলেন, ‘অভিযান পরিচালনা করলে বালু বিক্রেতারা জানায়, নদী থেকে বালু উত্তোলন করেনি। অন্যজন থেকে কিনে এনে বিক্রি করছে।’
পূর্বকোণ/পিআর