মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলা জান্তা-বিরোধী সংঘাত ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ইতোমধ্যে দেড় মাসের বেশি সময় পার হয়েছে এই সংঘাতময় পরিস্থিতির। মিয়ানমার জুড়ে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশটির অন্যান্য প্রতিবেশীর মতো বাংলাদেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আরাকান অঞ্চলের একাংশ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত। এপারে অবস্থান কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার কয়েকটি এলাকা। আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে মর্টারশেল ও গুলির শব্দ আবারও শুনেছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বসবাসকারীরা।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের আওতাধীন ৪৪, ৪৬ ও ৪৮ নম্বর সীমান্ত পিলার এলাকা দিয়ে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। যাতে কেঁপে উঠেছে সীমান্ত সড়কসহ আশপাশ এলাকা। বুধবার সকাল ৯টা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী থেমে থেমে প্রায় ৯টি বড় শব্দ ও ব্যাপক গুলির শব্দ মিয়ানমারের ভেতর থেকে জামছড়ি গ্রামে ভেসে আসে। সন্ধ্যার পর ৪৮ নম্বর পিলারের বিপরীতে আটটি মর্টারশেলের শব্দ আসে চেলিরটাল নামক এলাকায়। বিষয়টি নিশ্চিত করেন সীমান্তে বসবাসকারী মোহাম্মদ জহির, জাকারিয়া ও ছৈয়দ হোসেন।
তারা জানান, বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ সীমান্ত পেরিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার নাইক্ষ্যংছড়ির অভ্যন্তরে আসে। এর আগে প্রায় ৪৪ ঘণ্টা পর্যন্ত সীমান্তে সব পয়েন্ট দিয়ে কোনো বিস্ফোরণের আওয়াজ আসেনি।
কিন্তু বুধবার সকাল ও বিকেলে আসা বিস্ফোরণের বড় শব্দগুলো মিয়ামারের ভেতরে সাহেববাজার, বলিবাজার ও অংথাব্রে নামক জায়গা থেকে আসতে পারে বলে ধারণা করেছেন সীমান্তের কাছাকাছি বসবাসকারী মো. আবুল ও রহমান।
ধারণা করা হচ্ছে, ওপরে উল্লিখিত মিয়ানমারের ভেতরে ওই জায়গাগুলোতে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী আরকান আর্মির মাঝে সংঘর্ষের কারণে তাদের মধ্যে ব্যবহৃত ভারী গোলার বিকট শব্দের আওয়াজ আগের মতোই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসেছে।
রাখাইন রাজ্যের মংডুর উত্তরে নাকপুরা ও বলিবাজার এলাকায় সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে ২০ থেকে ২৫টি মর্টারশেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে নাফ নদীর এপারে টেকনাফের হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালীসহ কয়েকটি এলাকা কেঁপে ওঠে।
এর আগে, রবিবার রাতে মিয়ানমারের ওই দুই গ্রামে ৩৩ মিনিটে ২১টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে টেকনাফের হোয়াইক্যং ও হ্নীলা ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে।
নিজেদের অস্থিত্ব রক্ষায় জান্তা বাহিনীর সাথে আরাকান আর্মির চলছে সংঘর্ষ। ২২ মার্চ মিয়ানমারে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে। এরপর থেকে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ আরও তীব্র হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানায়, কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের নাফপুরা ও বলিবাজারে সশস্ত্র আরাকান আর্মির সদস্যরা অবস্থান নিয়ে সেখানকার সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সেক্টর দপ্তর ও একাধিক সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালাচ্ছে। সরকারি বাহিনীও তাদের অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করছে।
টেকনাফ স্থল বন্দরে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, পাঁচ-ছয় দিন ধরে আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের দক্ষিণ-পূর্ব শহর রাচিডংয়ে হামলা বাড়িয়েছে। মংডু থেকে আরাকান রাজ্যের রাজধধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) যাতায়াতের মধ্যভাগে রাচিডং শহরের অবস্থান। ইতোমধ্যে দখল হয়ে যাওয়া বিজিপির ঘাঁটিগুলো পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালাবে জান্তা বাহিনী। তখন মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছে।
হ্নীলার বাসিন্দা ইসমাইল বলেন, সোমবার রাতে তারাবির নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক রাত ১২টায় মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে বাড়িঘর কেঁপে ওঠে। এতে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। এরপর একটু ঘুম এলেও মঙ্গলবার ভোরে আবার গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। এখন সবাই আতঙ্কে আছি।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, রাত ঠিক ১২টায় মিয়ানমার থেকে মর্টারশেল বিস্ফোরণের এমন বিকট শব্দ ভেসে এলে আমিও আতঙ্কিত হই। পরে আমার এলাকার সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা যেন আতঙ্কিত না হয়, সে জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছি।
হ্নীলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেন, তারাবির নামাজ শেষ করে একটা দোকানে বসে আছি। হঠাৎ ওপার থেকে গুলি ও মর্টারশেলের বিকট আওয়াজ আসতে থাকে।
টেকনাফ ব্যাটালিয়ন-২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ জানান, খারাংখালী সীমান্তের পূর্বে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দ সীমান্ত এলাকায় শোনা গেছে বলে শুনেছি। তবে সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা যেন আতঙ্কিত না হয়ে নিরাপদে থাকতে পারে সে জন্য আমাদের বিজিবি টহল কার্যক্রম আগের মতো শক্ত অবস্থায় রয়েছে।
টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, মিয়ানমারের অব্যাহত সঙ্ঘাতের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সীমান্তে ইতোমধ্যে শতাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়েছে বলে শোনা গেছে।
যদিও বিজিবির শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধভাবে কোনো রোহিঙ্গাকে আর বাংলাদেশে ঢুকতে দেয়া হবে না।
পূর্বকোণ/মানিক/জেইউ/পারভেজ