বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীর হোসেন তালুকদার মুক্তিযুদ্ধকালীন নিজের এলাকা সরফভাটা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন। তাঁর সাথে এই দুই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে রাঙ্গুনিয়া আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এম সাদেক চৌধুরী।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন থানা আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম হাফেজ মোহাম্মদ শরীফ ও নুরুল হক চেয়ারম্যানসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে জনমত সৃষ্টিতে বিভিন্ন ইউনিয়ন, স্কুল-কলেজে সভা-পথসভার মাধ্যমে মাঠ চষে বেড়িয়েছিলেন তিনি। নবীর হোসেন তালুকদার কর্ণফুলী নদীপথে রাঙ্গুনিয়া ও কাপ্তাইয়ের পাক বাহিনীর ক্যাম্পের জন্য বিভিন্ন রসদ নিয়ে আসা ভাসমান বোটে গ্রæপ কমান্ডার অশোক মিত্র কারবারির নেতৃত্বে হামলা চালিয়েছেন কয়েকবার। নিজের গ্রাম সরফভাটায় পাঞ্জাবিদের সহায়তা করায় স্থানীয় বিহারীদের উপরও আক্রমণ চালান তারা। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা অপারেশনের মুখে স্থানীয় রাজাকারদের টার্গেটে পরিণত হয় নবীর হোসেন। রাজাকাররা প্রতিদিন পাহারা দিত কখন বাড়িতে ফিরেন তিনি।
নবীর হোসেন বলেন, স্থানীয় রাজাকার ও পাক বাহিনীর সৈন্যরা আমাকে বাড়িতে খুঁজতে আসত প্রায় সময়। খুঁজে না পেয়ে কয়েকবার আমার মা নছিমা খাতুনকেও বেধড়ক মারধর করেছিল রাজাকার ও পাক বাহিনীর সদস্যরা। সেই যন্ত্রণা এখনো আমাকে কাঁদায়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কথাগুলো বলেছেন রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম সরফভাটা ছনাগাজী তালুকদার বাড়ির মরহুম নাজির বক্স তালুকদারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নবীর হোসেন তালুকদার।
ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক নবীর হোসেন তালুকদার বলেন, নুরুল হক চেয়ারম্যানের অনুপ্রেরণায় জুলাই মাসের দিকে পদুয়া ইউনিয়ন দিয়ে আমিসহ ৩৫ জনের একটি দল ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য যাই। সেখানে দীর্ঘ একমাস প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে যোগ দিই সরফভাটা বড়খোলাপাড়া জমির আলীর খামারে স্থাপিত ক্যাম্পে। সেখান থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা অশোক মিত্র কারবারির নেতৃত্বে আমরা পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অপারেশনে অংশ নিই। এরমধ্যে গোডাউন ও কোদালা চা বাগানে অভিযানকালে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। সরফভাটার চিরিঙ্গা পাহাড় থেকে কর্ণফুলী নদীপথে চলাচলকারী পাকবাহিনীর বিভিন্ন বহরে নিয়মিত হানা দিতাম আমরা।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীর হোসেন তালুকদার বলেন, একদিন রাঙ্গুনিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার ছালেহ আহমেদ আমাকে দিয়ে দুটি চিঠি চট্টগ্রাম শহরের এসএম ইউসুফ এবং মৌলভী সৈয়দের কাছে পাঠিয়েছিলেন। চিঠি দুটো নিয়ে যাওয়ার পথে মদুনাঘাট পৌঁছালে বাস থেকে সবযাত্রীকে নামিয়ে চেক করছিলেন পাক বাহিনীর সদস্যরা। চিঠিগুলো ফেলে দেয়ারও কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। আমাকে যখন চেক করা শুরু করে তখন আমি বুদ্ধি করে রাঙ্গুনিয়া কলেজের আইডি কার্ড বের করে ছাত্র পরিচয় দেয়ায় কোনমতে রক্ষা পেয়েছিলাম। বুকপকেটে চিঠিগুলো পেলে সেদিন হয়ত পাঞ্জাবিরা প্রাণে মেরে ফেলত।
স্বাধীনতার পরও আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত নবীর হোসেন এখন সরফভাটা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নিজ এলাকায় ২০১০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কিন্ডারগার্টেন এবং বঙ্গবন্ধু গণপাঠাগার ও তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২০২২ সালে করোনা আক্রান্ত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এই মুক্তিযোদ্ধা এখন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা চালাতে গিয়ে সহায় সম্বল সবই হারিয়েছেন। চিকিৎসা সহায়তা পেতে রাঙ্গুনিয়ার সাংসদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর আবেদনও করেছেন। আর্থিক সহায়তা পেতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নবীর হোসেন।
পূর্বকোণ/এএইচ