চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজুর রহমান

২৮ মার্চ শহর থেকে বাড়ি আসি ভারতে যাওয়ার জন্য

খোরশেদ আলম শিমুল, হাটহাজারী

৪ মার্চ, ২০২৪ | ১:২৫ অপরাহ্ণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মফিজুর রহমান বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর সচেতন বাঙালিরা সতর্ক অবস্থান নিতে শুরু করে। পরিস্থিতি থমথমে। ২৫ মার্চ রাতে মনে হলো এ শহরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই! জানালার পাশের নারিকেল গাছটি ঝাঁঝরা হয়ে গেল গুলিতে। জানালায় উঁকি দিতেই মনে হলো এর পরের গুলিটি এসে বিদ্ধ হবে আমার বুকে! ।

হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের বংশাল এলাকার মরহুম হাজি সুলতান আহমেদের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান। যুদ্ধকালীন তিনি চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বলেন, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এটি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান। দিনের বেলায় চারদিক থেকে খবর আসছে, রাজারবাগ পুলিশ লেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালিয়েছে। পুরোশহর নিস্তব্ধ হয়ে আছে। রাস্তাঘাট ফাঁকা।

২৮ মার্চ সকাল ১০টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। অক্সিজেন নাজিরহাট রোডের নতুন পাড়া থেকে একটি গাড়িতে করে কাটিরহাট আসি। তারপর পায়ে হেঁটে ফরহাদাবাদের বংশালে বাড়িতে পৌঁছি। রাত তখন প্রায় ১১টা। রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সচেতন। আমার চাচা শেখ নুরুল ইসলাম, আবুল বশরসহ অন্যদের নেতৃত্বে আমরা পালাক্রমে এলাকা পাহারা দিতে শুরু করি। নূর হোসেন মেম্বারের বাড়ি থেকে আমাদের সব পরিকল্পনা হতো। তার ছদ্মনাম ছিল “বাজান”।

বংশাল-রোসাংগিরি হালদা ঘাট ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ পারাপারের জায়গা। শুধু হাটহাজারী-রাউজান-চট্টগ্রাম শহর নয়, দক্ষিণ চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারাও এ ঘাট দিয়ে পার হতেন। রোসাংগিরি-আজিমনগর-মাইজভান্ডার-চাড়ালিয়াহাট-কাঞ্চনপুর-মানিকছড়ি রাজবাড়ি-তিনটেইরি-ফেনী খাল পার হয়ে সাব্রুম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করতো শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধারা। আমি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের সাথে এপ্রিল পর্যন্ত এলাকা পাহারা দিই। এরইমধ্যে আমরা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছি ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেব।

যেদিন ভারতে যাওয়ার জন্য রওনা হই, তার কয়েকদিন আগে রোসাংগিরির ওখাড়া গ্রামের ফররুখ সারাংয়ের ছেলে আবদুর রাজ্জাককে পাকিস্তান আর্মি গুলি করে হত্যা করে। ফলে এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করে। অন্যদিকে ফরহাদাবাদের চেয়ারম্যান সৈয়দ আহমদ মিয়া (সৈয়দ কোম্পানি) মুসলিম লীগের সমর্থক হলেও তিনি ফরহাদাবাদে রাজাকার ও শান্তি কমিটি গঠন করতে দেননি। এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শও দিয়েছেন।

চাচাতো ভাই জেঠাতো ভাইসহ ২৫ জনের একটি দল সেকান্দর মিয়ার নেতৃত্বে আমরা বংশাল থেকে রওনা দেই। যাবার সময় ভয়ে বাবাকে বলিনি, মাকে বলেছিলাম। মা ১০ টাকার দুটি নোট হাতে দিয়ে দোয়া করে দিয়েছেন। ছোটভাই মঞ্জুর বয়স তখন দুবছর।

খাগড়াছড়ি সাব্রুম অভ্যর্থনা ক্যাম্পে আওয়ামী লীগ নেতা এম এ ওহাব মিয়া, ডা. মাহমুদুল হক (সাবেক সেনাপ্রধান হারুন সাহেবের পিতা) ও নানুপুরের গুরামিয়ার সাথে দেখা হয়। আমাদের হরিণা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর পালাটোনা ট্রেনিং সেন্টারে রাত দুটায় পৌঁছি। পরদিন সকাল ১০টার দিকে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এসে আমাদের রিসিভ করেন। এরপর উদয়পুর কলেজের বারান্দায় আমাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু আপাতত রান্না নিজেদের করতে বলেছেন। পরে যুইগ্যাছোলার ৭-৮ জন জুম্মা রান্নার দায়িত্ব পায়।

পরদিন নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের গ্রুপকে আলাদা করা হয়। চট্টগ্রামের গ্রুপটি ফেনী ক্যাম্পের সাথে থাকে তিন সপ্তাহ। এরপর বগাপা ট্রেনিং সেন্টারে শুরু হয় ১ মাসের সশস্ত্র ট্রেনিং। ট্রেনিং শেষ হলে ৭০০ জন থেকে আমাকেসহ ১৪ জনকে বাছাই করা হয়। এরা প্রত্যেকেই দলপতি। দল পরিচালনা, অস্ত্র চালনা ও বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের তৈরি করা হয়।

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন