আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মনোনয়ন ঘোষণা ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমদকে (সিআইপি) দলীয় মনোনয়ন দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয় ২৬ নভেম্বর বিকালে।
ওই ঘোষণার পরপরই চকরিয়ায় ফুসে উঠেছে চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলমের সমর্থকরা। তারা তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। চেষ্টা করেছে সড়ক অবরোধের।
অপরদিকে, সালাহউদ্দিন আহমেদ মনোনয়ন পেয়েছেন খবরে আনন্দ উদ্বেলিত হয়ে উঠে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত ও নিপীড়িত দলীয় নেতা-কর্মীরা। চকরিয়া-পেকুয়ার বেশ ক’টি স্টেশনে মিষ্টি বিতরণ হয়, বিভিন্ন ইউনিয়নে বের হয় আনন্দ মিছিল।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পরপরই মনোনয়ন বঞ্চিত জাফর আলমের পক্ষের অনুসারীরা চকরিয়া পৌরশহরের বাস টার্মিনাল ও সিস্টেম কমপ্লেক্সের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করে। টার্মিনাল পয়েন্টে সড়ক অবরোধের চেষ্টা ও দুটি গাড়ি ভাংচুর হলে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে র্যাব-বিজিবি ও পুলিশের যৌথ বাহিনী সাথে সাথে ছুটে গিয়ে ধাওয়া দিলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা।
রবিবার বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় এমপির ছেলে তানভীর আহমদ সিদ্দিকী তুহিন, স্ত্রী শাহেদা বেগম, সাহারবিল ইউপি চেয়ারম্যান নবী হোছাইন, হারবাং ইউপি চেয়ারম্যান মেহরাজ উদ্দিন মিরাজের নেতৃত্বে।
সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুর ২টার পর আবারও শোডাউন ও সমাবেশের আয়োজন করা হয় এমপি জাফরের পক্ষে। এ দিন কয়েকশত গাড়ি নিয়ে লোক সমাগম ঘটানো হয়। এই সমাবেশে খোদ সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম বক্তব্য রাখেন। এই সমাবেশে কয়েকজন চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতা বক্তব্য দেন।
দু’দিনের সমাবেশে এমপি পুত্র তুহিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চকরিয়া-পেকুয়া ও মাতামুহুরী সাংগঠনিক থানাসহ প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি আমার বাবা জাফর আলমের পক্ষে। আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম বিএনপির সাবেক মন্ত্রী এপিএস সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে লড়ে জিততে। সেখানে দেয়া হয়েছে আরেক জনবিচ্ছিন্ন পেরেক সালাহউদ্দিনকে। যার কোন ভিত্তি নেই এলাকায়। সে একজন রাজাকার পুত্র। তিনি শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। তাঁকে নৌকা দিলেও সে ড্যামি প্রার্থী। তার পক্ষে কেউ আঙ্গুল তুললে সেই আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়া হবে, কথা বললে উচিত জবাব পাবে।
তিনি আরও বলেন, বাবার নৌকার প্রয়োজন নেই, কোন মার্কারও প্রয়োজন নেই। নিজের সাজানো বাগানে এমনিতেই জিতে আসবেন। সালাহউদ্দিনকে নৌকা দিলেও আমার বাবা জাফর আলম শেখ হাসিনার আস্থাভাজন ও আসল প্রার্থী। সালাহউদ্দিন বিএনপির সালাহউদ্দিন ও তার স্ত্রী হাসিনা আহমদের কাছে তিনবার লাথি খেয়েছে। এবার আমার বাবা জাফর আলমের লাথি খাবে।
বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম নৌকার মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদকে রাজাকার পুত্র আখ্যা দিয়ে বলেন, ৪৩ বছর নৌকা আমার এলাকায় ডুবে ছিল। নৌকাটা কোনভাবে পুনরুদ্ধার করেছিলাম। সেই নৌকাটি আবারও তিনবারের পরাজিত একজন রাজাকার পুত্র সালাহউদ্দিনের হাতে যাক। তাই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য ঘোষনা দিচ্ছি।
চকরিয়া পৌর আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট ফয়জুল কবির, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন মানিক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক জামাল উদ্দিন জয়নাল, চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী, চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
তারা বলেছেন, আমরা ধাপে ধাপে রাজনীতি করে আওয়ামী লীগে উঠে এসেছি। দলের সুনাম ধরে রাখতে বলায় আমারসহ পুরো সংসদীয় আসনটির সাংগঠনিকসহ তিনটি উপজেলার পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের কোনঠাসা করে রেখেছিলো জাফর আলম। তার ব্যক্তিবলয় সৃষ্টি করতে তার পছন্দনীয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিরোধী লোকজনকে নিয়ে কাজ করেছে। এতে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে। দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুযোগ্য নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে মনোনয়ন দিয়ে আমাদের স্বস্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। আশা করছি সালাহউদ্দিন আহমদকে জিতিয়ে জননেত্রীর কাছে গিয়ে দলের জন্য ত্যাগী অথচ নিপীড়িত-বঞ্চিত নেতারা মূল্যায়িত হবে।
আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদ (সিআইপি) বলেন, ১৯৭৩ সালের পর ২০১৮ সালে অর্থাৎ ৪৫ বছর পর আমরা বঙ্গবন্ধুর সৈনিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার প্রার্থী জাফরকে জিতিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম তার মাধ্যমে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ আর শক্তিশালী হবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নয়, এখানে গড়ে তুলা হয়েছে জাফর লীগ। বেপরোয়া অস্ত্রবাজী ছাড়াও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছে জাফর। এতে বঙ্গবন্ধুর গড়া আওয়ামী লীগের সুনাম ক্ষুন্ন হয়েছে। এবার জিতে সেই বদনাম ঘুচিয়ে কক্সবাজার-১ আসনকে শেখ হাসিনার ঘাটিতে পরিণত করা হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সুযোগ দেয়া হবে পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।
তিনি আরও বলেন, ইতিপূর্বে আমি তিনবার মনোনয়ন পেলেও দলের অভ্যান্তরীন গ্রুপিং ও ঘাপটি মেরে থাকা মীরজাফরদের কারণে জয় হাতছাড়া হয়েছে। অতীতের শিক্ষা পুজি করে এবার অবশ্যই নৌকাকে বিজয়ের মাধ্যমে আমার উপর আস্থা রাখা জননেত্রী শেখ হাসিনার মুখে হাসি ফুটাব।
এদিকে, সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুর ২টার দিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমদের পক্ষে ইসির মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সহকারি রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্বপ্রাপ্ত চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ানের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সরওয়ার আলম, মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহসিন বাবুল, অধ্যাপক আ.ক.ম গিয়াস উদ্দিন, সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক জামাল উদ্দিন জয়নাল, পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ নেতা এসএম আলমগীর হোসাইন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন প্রমুখ।
পূর্বকোণ/জেইউ