চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

নীরবে চলছে হিসাব-নিকাশ

­­­বরাবরই ফ্যাক্টর পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো

সাখাওয়াৎ হোসেন রুবেল, রাঙামাটি

১৩ নভেম্বর, ২০২৩ | ১২:৩২ অপরাহ্ণ

বর্তমানে ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি পার্বত্য জেলা। জেলার বর্তমান আয়তন ৬১১৬.১১ বর্গ কিলোমিটার। নির্বাচনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব থাকলেও রাঙামাটিসহ পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষেত্রে বরাবরই ফ্যাক্টর পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো।

 

আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থনেই পাল্টে যায় ভোটের হিসাব-নিকাশ। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখনও জোর তৎপরতা না থাকলেও নীরবে নিজেদের সম্ভাব্যপ্রার্থী নিয়ে ভাবছে রাজনৈতিক দলগুলো। প্রত্যেক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এককপ্রার্থী থাকলেও এবারের নির্বাচনেই কেবল নতুন প্রার্থীর আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

 

১৯৯১ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে টানা ছয়বার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করছেন বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ সদস্য দীপংকর তালুকদার এমপি। ছয়টি নির্বাচনের মধ্যে চারটিতেই বিজয়ী হয়েছেন তিনি। বাকি দুটি নির্বাচনের মধ্যে একটিতে আঞ্চলিক দল ও আরেকটিতে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন।

 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ নির্বাচন হিসাবে তখন ঘোষণা থাকলেও এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দলের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে দীপংকর তালুকদার ভোটে দাঁড়াবেন,  বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলছেন তার অনুসারীরা। তবে এবারের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইতে পারেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা। এছাড়া রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের অপর সহ-সভাপতি সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চিং কিউ রোয়াজা’র নামও বলছেন দলের কেউ কেউ।

 

জেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এতদিন দীপংকর তালুকদারের একক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকলেও তবে সর্বশেষ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে দীপংকর তালুকদার ও নিখিল কুমার চাকমা’র মধ্যে সভাপতি পদে প্রার্থিতা নিয়ে দু’জনের রাজনৈতিক বৈরিতা প্রকাশ্যে এসেছে। সেই সম্মেলনে দলের ‘হাইকমান্ডের অনুরোধে’ দীপংকর ফের সভাপতি হলেও এবারের সংসদ নির্বাচনে নিখিল কুমার চাকমা দলীয় প্রার্থী হতে জোর তদবির চালাচ্ছেন বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্রগুলো।

 

২০০৮ সাল থেকে সন্তু লারমার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) দলীয় সমর্থনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী দেওয়ায় রাঙামাটির নির্বাচনে আঞ্চলিক দল আওয়ামী লীগের কাছে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পরবর্তী এর আগের নির্বাচনগুলোতে জেএসএস জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে সমর্থন দেওয়ার দাবি করলেও  ২০০৮, ২০১৪ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের নিজেরাই প্রার্থী দিয়েছে। এরমধ্যে ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে বিজয়ী ও ২০০৮ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরেছে।  সে কারণে আওয়ামী লীগ বনাম আঞ্চলিক দল জেএসএস এর মধ্যে আসন্ন নির্বাচনে কোন প্রকার সমঝোতা হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়।

 

জানা গেছে, ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে জেএসএস সমর্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঊষাতন বিজয়ী হলেও সেই নির্বাচনে আরও দুটি আঞ্চলিক দল স্বতন্ত্রপ্রার্থী দিয়েছিল। এরমধ্যে ইউপিডিএফ-সমর্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী ছিলেন সচিব চাকমা এবং জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা/ সংস্কারপন্থী) সমর্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী ছিলেন সুধাসিন্ধু খীসা। তবে বিগত দুই নির্বাচনে আর প্রার্থী দেয়নি জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) ও ইউপিডিএফ।

 

গত নির্বাচনে ইউপিডিএফ সমর্থন জানিয়েছিল সন্তু লারমার জেএসএসকে। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) সমর্থন জানিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। এবারের নির্বাচনেও জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা) প্রার্থী দেবে কিনা জানা যায়নি, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকেই সমর্থন জানাতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

 

সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির  (জেএসএস) সমর্থিত স্বতন্ত্রপ্রার্থী ঊষাতন তালুকদারকে সমর্থন জানিয়েছিল প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন পাহাড়ের আরেক ‘হেভিওয়েট’ আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস্ধসঢ়; ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউনাইটেড)। সে সময়ে জেএসএস-ইউপিডিএফ’র ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ থাকায় রাঙামাটি আসনে একত্রে ভোট করেছিল দুটি আঞ্চলিক দলই। তবে বর্তমান সময়ে আবারও জেএসএস-ইউপিডিএফের রাজনৈতিক বৈরিতা চলছে। যে কারণে এবারের নির্বাচনে একইপ্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ইউপিডিএফ বলছে, রাজনৈতিক দল হিসাবে তারা বরাবরই গণতন্ত্রমুখী।

 

দ্বাদশ নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফ বরাবরই গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের মতো পরিবেশ তৈরি হয় তাহলে ইউপিডিএফ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে প্রার্থিতা ঘোষণা করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আমরা কাকে প্রার্থী ঘোষণা করতে পারি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো পার্টির পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি।’

 

স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের সংসদ নির্বাচনেও বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে আঞ্চলিক দলগুলো। তবে বিএনপি নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণ করে সেক্ষেত্রে বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়েও খুব বেশি বলা যাচ্ছে না। তবে প্রার্থী হতে পারেন এমন তিনজন শীর্ষ নেতার নাম নেতাকর্মীদের মধ্যে শোনা যাচ্ছে। সম্ভাব্যপ্রার্থী যারা হতে পারেন তাঁরা হলেন- সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান, কেন্দ্রীয় বিএনপির সহ-উপজাতীয় বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) মনীষ দেওয়ান ও জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু। দলটির নেতাকর্মীরা বলছেন, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ানের বিকল্প নেই।

 

তবে এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার দীপু  বলেন, ‘আমরা এক দফা দাবিতে সারাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম করে যাচ্ছি। সেন্ট্রালের কড়া অর্ডার আছে, আন্দোলন সংগ্রামের পরই নির্বাচনে কে প্রার্থী হতে পারে এসব নিয়ে ভাবনা। তাই আপাতত প্রার্থিতা নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই।’ বিগত নির্বাচনগুলোয় সাবেক উপমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ছিলেন; বিএনপি যদি দ্বাদশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেখানে মনিস্বপনের বিকল্প হিসাবে কেউ থাকতে পারেন কিনা জানতে চাইলে দীপু বলেন, ‘দলের সভাপতি হিসাবে আমারও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাও যদি নেতা-কর্মীরা চান।

 

সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কোনো নেতার মন্তব্য পাওয়া যায়নি। জেএসএস সমর্থিত একবারের এমপি ঊষাতন তালুকদারের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। বক্তব্য পাওয়া যায়নি জনসংহতি সমিতিরও (এমএন লারমা)।

 

এদিকে, আওয়ামী লীগ থেকে এবারের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রাক্তন চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিখিল কুমার চাকমা বলেন, ‘এখনো দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়নি। তফসিল ঘোষণার পরপরই বলা যাবে নির্বাচনে প্রার্থী হবো কিনা’।

 

গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টির, কে এম পারভেজ তালুকদার, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির জুঁই চাকমা ও ইসলামী আন্দোলনের জসিম উদ্দিন প্রার্থী হয়েছিলেন।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন