চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

স্বপ্নপূরণের দিন আজ

মিজানুর রহমান

১১ নভেম্বর, ২০২৩ | ১২:২৭ অপরাহ্ণ

এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে কক্সবাজারের মানুষ। শত বছরের অপেক্ষা শেষে আজ শনিবার দেশের ৪৫তম জেলা হিসেবে রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এ পর্যটন নগরী। এরমধ্য দিয়ে ট্রেনে চড়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহরে যাওয়ার যে স্বপ্ন দেশের ভ্রমণপ্রিয় মানুষ এতোদিন ধরে দেখে আসছিলেন সেটি সত্যি হচ্ছে। বৃটিশ, পাকিস্তান আমলেও যা সম্ভব হয়নি- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সেটি বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।

 

শনিবার দুপুরে কক্সবাজার প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মিত একশ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইনের উদ্বোধন করবেন। এরআগে কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশনে আয়োজিত সুধী সমাবেশে বক্তব্য দেবেন তিনি। পরে সেখান থেকে রামু রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার ট্রেনে চড়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথের আনুষ্ঠানিক সূচনা করবেন প্রধানমন্ত্রী। তার এ ট্রেনযাত্রায় রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনও সঙ্গী হবেন।

 

বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস : শত বছর ধরে দেশের সর্ব দক্ষিণের রেলওয়ে স্টেশনের নাম ছিল দোহাজারী স্টেশন। তাই মানুষের মুখে মুখে এটির নামই হয়ে যায়- ‘আখেরি স্টেশন’! তবে এখন দোহাজারী থেকে আরও দক্ষিণে প্রায় ১০১ কিলোমিটার রেলপথ গিয়ে পৌঁছেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত। নিজেদের আঙিনায় ‘নিরাপদ ও সাশ্রয়ী বাহন’ ট্রেন আসার খবরে উচ্ছ্বসিত কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজার জুড়েই চলছে সাজ সাজ রব।

 

সম্ভাবনার নতুন দ্বার : বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নে নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ প্রকল্পটি চালু হওয়ায় এখন ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ট্রেনে ‘পর্যটন নগরী’ কক্সবাজার যাওয়া সম্ভব হবে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ঘিরে কক্সবাজারে গড়ে উঠা পর্যটন শিল্পের দ্রুত প্রসার ঘটবে। কক্সবাজারের মাছ, লবণ, শুঁটকি, চিংড়ি, দোহাজারীর সবজি পরিবহন সাশ্রয়ী হবে।

 

এছাড়া কক্সবাজার থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করে সেখানে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দরের পণ্য সারাদেশে সহজে পরিবহন করা যাবে। রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ করে মিয়ানমার হয়ে চীন পর্যন্ত ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে বাংলাদেশ। যা দেশের যোগাযোগ খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে।

 

পথে পথে প্রকৃতি : আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২০০৯ সাল থেকে গত ১৫ বছরে দেশে ১ হাজার ৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত একশ কিলোমিটার রেললাইনকে অনন্য হিসেবে আখ্যায়িত করছেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন- দেশের আর কোনো রেললাইন জুড়ে এতো বৈচিত্র্যময় ও চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য নেই। কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে আসা ট্রেন শতবর্ষী কালুরঘাট সেতু দিয়ে কর্ণফুলী পার হয়ে সবুজে ঘেরাগ্রাম দিয়ে যেতেই পাহাড়ের ভেতর হারাবে। লোহাগাড়ার চুনতী অভয়ারণ্যে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতি, বানর কিংবা অন্যবন্য প্রাণীর। এরপর পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা, রাবারড্যাম, নদীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে কখন সাড়ে তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষ করে ট্রেন কক্সবাজার পৌঁছে যাবে তা বুঝতেও পারবেন না যাত্রীরা।

 

প্রথম এলিফ্যান্ট ওভারপাস : দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনের চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে নির্মাণ করা হয়েছে- দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এলিফ্যান্ট ওভারপাস। যার উচ্চতা সাড়ে ৯ মিটার এবং প্রশস্ততা ১৩৯ মিটার। ওভারপাস সংলগ্ন রেললাইনের দুই পাশে তৈরি করা হয়েছে সুরক্ষা ব্যারিয়ার। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন- ওভারপাসের উপর দিয়ে হাতি আর নিচ দিয়ে যাবে ট্রেন যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটিও দেশের কোনো রেললাইনের ক্ষেত্রে প্রথম ঘটনা।

 

পর্যটকবান্ধব রেলওয়ে স্টেশন : সমুদ্রসৈকত থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের প্রায় ২৯ একর জায়গাজুড়ে আন্তর্জাতিক মানের দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশন করা হয়েছে কক্সবাজারে। ঝিনুকের আদলে নির্মিত এ স্টেশন নির্মাণ ব্যয় ২১৫ কোটি টাকা। এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয় তল বিশিষ্ট স্টেশনটির সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট।

 

কক্সবাজারে পর্যটকদের অর্ধেকই আসেন একদিনের জন্য। এ সময় তারা নিজেদের মালপত্র রাখার নিরাপদ জায়গা পান না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্টেশনে রাখা হচ্ছে লাগেজ ও লকার সিস্টেম। এছাড়া রয়েছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া; পার্কিং এরিয়া; সুপারমার্কেট, ফার্মেসি, এটিএম বুথ, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা কেন্দ্র।

 

৫৫ টাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার : আজ শনিবার রেললাইনের উদ্বোধন হলেও স্বপ্নের এ রেলযাত্রার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের পরিবহন দপ্তর ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে চলাচলের জন্য ট্রেনযাত্রার সূচি রেলভবনে পাঠালেও তা এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। কোন দিন থেকে বাণিজ্যিকভাবে এ রুটে ট্রেন চলবে তাও এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে এ রুটে ট্রেনের ভাড়ার চার্ট চূড়ান্ত করা হয়েছে।

 

চূড়ান্ত ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী- চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে লোকাল ট্রেনের (দ্বিতীয় শ্রেণি) ভাড়া ৫৫ টাকা, মেইল ট্রেনের ভাড়া ৭০ টাকা এবং কমিউটার ট্রেনের ভাড়া ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এ রুটে আন্তঃনগর ট্রেনের শোভন চেয়ারে ২০৫ টাকা, স্নিগ্ধায় ৩৮৬ টাকা, এসি সিটে ৪৬৬ টাকা এবং এসি বার্থে ৬৯৬ টাকা ভাড়া ধরা হয়েছে। ঢাকা থেকে সরাসরি যেতে চাইলে এরসঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামের ভাড়া যোগ হবে।

 

প্রকল্পের সার সংক্ষেপ : ২০১০ সালে ৬ জুলাই দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অনুমোদন পায়। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ মেগা প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে প্রকল্পপ্রস্তাব সংশোধনের পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।এডিবির সঙ্গে চুক্তির পর সরকার ও এডিবি মিলে এই প্রকল্পে জন্য ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থের জোগান দেয়।

 

২০১৮ সালে ডুয়েলগেজ সিঙ্গেল ট্র্যাকের এ রেললাইন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের অধীনে ১০২ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসানো হয়েছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথে ৩৯টি ব্রিজ এবং আন্ডারপাসসহ ২৫১টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে।গত ৫ নভেম্বর দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথে প্রথম পরিদর্শন ট্রেন চালানো হয়। এখন ৬০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে এ পথে।

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট