চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

আ. লীগের একক প্রার্থী ড. হাছান, বর্গা দিতে রাজি নয় বিএনপি

ইসলাম জিগার, রাঙ্গুনিয়া

১৭ অক্টোবর, ২০২৩ | ১১:৪৯ পূর্বাহ্ণ

লুসাই কন্যা কর্ণফুলী নদীর দু’পাশের পাহাড় ও সমতল বিস্তৃত সবুজ জনপদ রাঙ্গুনিয়া উপজেলা। শস্য ভাণ্ডার খ্যাত গুমাই বিলে বাম্পার ফলনের পাশাপাশি সবজি উৎপাদনেও রয়েছে এই উপজেলার খ্যাতি। স্বাধীনতার পর ৩৭ বছর ধরে উন্নয়ন ও নেতৃত্ব বঞ্চিত রাঙ্গুনিয়া বিগত সাড়ে চৌদ্দ বছরে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে অবকাঠামো উন্নয়ন, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রে। চট্টগ্রাম-৭ সংসদীয় আসন রাঙ্গুনিয়ার ১৫ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভার সাথে যুক্ত হয়েছে পাশের বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নও। এই আসনের পরবর্তী সংসদ সদস্য প্রার্থী নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোতে শুরু হয়ে গেছে নানা জল্পনা-কল্পনা আর হিসাব-নিকাশ।

 

মনোনয়ন দৌড়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের একক আধিপত্য এবং প্রার্থিতা অনেকটা নিশ্চিত হলেও প্রধান বিরোধীদল বিএনপিতে রয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ড বলতে দৃশ্যমান কিছুই নেই রাঙ্গুনিয়ায়, গ্রুপিং দ্বন্দ্বও আছে প্রকট। তবে ত্রি-ধারায় বিভক্ত রাঙ্গুনিয়া বিএনপির নেতারা মনোনয়ন যিনি ছিনিয়ে আনতে পারবেন তার পক্ষেই একাট্টা হবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও পিছিয়ে নেই নির্বাচনী দৌড়ে। ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে পাশের উপজেলা রাউজান থেকে এনে হেভিওয়েট নেতা মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রাঙ্গুনিয়ায় প্রার্থী করে বিএনপি। প্রথম দুটি নির্বাচনে স্বল্প ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের সাদেক চৌধুরীকে হারিয়ে জয়ী হলেও ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ড. হাছান মাহমুদের কাছে ৩১ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোটে অংশ নেয়নি বিএনপি। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দৌড়ে থাকা বিএনপির অর্ধডজন প্রার্থীকে পেছনে রেখে জোট শরিকএলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল আলমের হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেন বিএনপি। সেবার প্রথমে মনোনয়ন দেয়া হয় বিএনপির অধ্যাপক কুতুব উদ্দিন বাহারকে, একদিন পর পরিবর্তন করে দেয়া হয় নুরুল আলমকে। এবারও জোটের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নিশ্চিত বাগড়া বসাতে চাইবেন ১৯৮০ ও ৯০ দশকে রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপিকে তৃণমূলে সংগঠিত করা নুরুল আলম। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন বিএনপির রাঙ্গুনিয়ার অর্ধডজন নেতা, পাশাপাশি রাউজানের সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পরিবারও তৎপর এই আসনে অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষায়। তবে ভোটারদের কাছে বহিরাগত ও উন্নয়ন ইস্যু ম্লান করতে রাউজানের চৌধুরী পরিবারের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চান বিএনপির বৃহদাংশ। তারা চান রাঙ্গুনিয়ার কোন সন্তানকে প্রার্থী করতে। হাই কমান্ডের কাছে তৃণমূল নেতাদের বৃহদাংশের দাবি বিএনপির রাজনীতি করেন রাঙ্গুনিয়ার সন্তান যার হাতেই ধানের শীষ প্রতীক দেয়া হোক না কেন তারা জিতিয়ে আনতে একাট্টা হয়ে কাজ করবেন। সরকারি দলের নানা হুমকি-ধমকি ও হামলা-মামলার মধ্যে দলের হাল ধরে থাকা তৃণমূল নেতাকর্মীরা প্রার্থী-প্রতীক কোনটাই আর বর্গা দিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছেন উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজিবুল আলম, সরফভাটা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার ওসমান গণি ও লালানগর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি লিয়াকত আলী মেম্বারসহ কয়েকজন তৃণমূল নেতা।

 

বিগত ৬টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ আসনে একক কোনো দলের আধিপত্য নেই। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. ক্যাপ্টেন আবুল কাশেম। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা রাউজানের মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর  জেষ্ঠ্য সন্তান মরহুম সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয়পার্টির টিকেটে তার ভাই গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বিজয়ী হন। ১৯৮৮ সালে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে জাতীয়পার্টির নজরুল ইসলাম জয়ী হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন আ. লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটের প্রার্থী নৌকা প্রতীকে সিপিবি নেতা মোহাম্মদ ইউসুফ। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী মোহাম্মদ নুরুল আলম। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম সংসদ নির্বাচনে জয়ী হন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী জয়ী হন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা ড. হাছান মাহমুদ জয়ী হন। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের ড. হাছান মাহমুদ নির্বাচিত হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও ড. হাছান মাহমুদ ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী এলডিপি নেতা নুরুল আলমকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে টানা তৃতীয়বারের মত এমপি নির্বাচিত হন।

 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বড় দুই দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে বর্তমান এমপি ড. হাছান মাহমুদের একক আধিপত্য মাঠ পর্যায়ে বিস্তৃত। কেন্দ্রেও তার মনোনয়নের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ১নং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। তাঁর বাইরে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে এখনো কেউ মাঠ পর্যায়ে দৃশ্যমান আগ্রহ দেখাননি। রাঙ্গুনিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। পরপর তিনবার নির্বাচিত হয়ে গত সাড়ে চৌদ্দ বছরে তিনি রাঙ্গুনিয়ায় দশ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ সম্পাদন করেছেন। যাতায়াত ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নসহ নির্বাচনী এলাকার প্রায় পাঁচ হাজার ছেলেমেয়েকে সরকারি-বেসরকারি চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন তিনি।

 

অপরদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির অর্ধডজন নেতা এবারও মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক কুতুব উদ্দিন বাহার গতবার মনোনয়ন পেয়েও জোটের আসন ভাগাভাগির খড়গে পড়ে একদিন পর মনোনয়ন হাতছাড়া হয়। এবারও তিনি মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে বলেন, এখানে বিএনপিকে ঘায়েল করতে আওয়ামী লীগের বড় হাতিয়ার হল বহিরাগত ও উন্নয়ন প্রচারণা, সেটি প্রার্থী হোক বা প্রতীক হোক। রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপিতে অনেক যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য প্রার্থী আছে, যাকেই দিক না কেন জিতে আসবে। রাঙ্গুনিয়া আসন পুনরুদ্ধার করতে হলে প্রার্থী-প্রতীক কোনটাই বর্গা দিতে রাজি নয় বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পূর্বকোণকে এমনটাই জানিয়েছেন অধ্যাপক কুতুব। একই কথা বলেছেন, অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী চট্টগ্রাম উত্তরজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ইউনুছ চৌধুরীও। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবু আহমেদ হাসনাত বলেন, রাঙ্গুনিয়ার ঘরে ঘরে বিএনপির কর্মী সমর্থকরা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এক্ষেত্রে প্রার্থী-প্রতীক যেমন গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতাও প্রাধান্য থাকা উচিৎ।

 

মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়ায় সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সহধর্মিণী ফারহাত কাদের চৌধুরী কিংবা মেঝ ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরীর মধ্যে যেকোন একজন বিএনপির প্রার্থী হবার সম্ভাবনা রয়েছে রাঙ্গুনিয়া আসনে। কোন কারণে চৌধুরী পরিবার থেকে কেউ প্রার্থী না হলে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক শওকত আলী নূর হবেন তাদের পছন্দের শীর্ষে। গতবারও অধ্যাপক কুতুব, আবু আহমেদ হাসনাত ও শওকত আলী নূর ছিলেন বিএনপির মনোনয়ন বোর্ডের সিলেকশনে।

 

বর্তমান উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য শওকত আলী নুর বলেন, চৌধুরী পরিবারই রাঙ্গুনিয়া বিএনপির কা-ারী। যদি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে ফারহাত কাদের চৌধুরী কিংবা হুম্মাম কাদের চৌধুরী রাঙ্গুনিয়ায় নির্বাচন করবেন। যদি কোন কারণে তারা প্রার্থী না হন সেক্ষেত্রে আমি মনোনয়ন চাইব দলের কাছে।

 

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয়পার্টির মহাজোটগত নির্বাচন না হলে জাতীয়পার্টি থেকে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক এমপি মো. নজরুল ইসলাম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। তবে রাঙ্গুনিয়ায় জাতীয়পার্টির চোখে পড়ার মতো সাংগঠনিক তৎপরতা ও কর্মী সমর্থক নেই। সুন্নী মতাদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক দল ইসলামী ফ্রন্ট নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে উপজেলা সভাপতি আলী শাহ নেছারী বলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যক্ষ তৈয়ব আলী, পীরজাদা গোলামুর রহমান আশরাফ শাহ ও তার নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তারা তৃনমূল পর্যায়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।

 

মুফতি আমিনীর প্রতিষ্ঠিত দল ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুফতি ফয়জুল্লাহ এবার এই আসনে প্রার্থী হবেন বলে জানিয়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি বেরিয়ে আসা ইসলামী ঐক্যজোট আগামী নির্বাচনে এককভাবে দলীয় প্রতীক মিনার নিয়ে মাঠে থাকবেন বলে জানান।

হাছান মাহমুদ এমপি বলেন, তিন মেয়াদে রাঙ্গুনিয়ায় প্রায় দশ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি উন্নয়ন কাজ করেছি। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, মসজিদ, মন্দির নির্মাণে এই টাকা ব্যয় হয়েছে। ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দেশের প্রথম শেখ রাসেল এভিয়ারি পার্ক ও ক্যাবল কারের উন্নয়নে আরো ১’শ ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প বর্তমানে চলমান। সাড়ে ৪ শ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী নদীর ভাঙনরোধ ব্লক বসানো হয়েছে। পাইপলাইনে আছে আরও শত কোটি টাকার প্রকল্প। তিনি বলেন, ‘শুধু সরকারি টাকায় নয়, রাঙ্গুনিয়ার প্রতিটি ইউনিয়নে দরিদ্র কৃষকদের পাওয়ার টিলার, রিকশা, ভ্যান দিয়েছি ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থায়নে। রোগী ও মরদেহ পরিবহনের জন্য এম্বুলেন্স ও ফ্রিজার ভ্যান দিয়েছি নিজ উদ্যোগে। প্রায় পাঁচ হাজার লোকের সরকারি-বেসরকারি চাকরির ব্যবস্থা করেছি। এত উন্নয়ন অতীতে আর কেউ করেনি এখানে। রাঙ্গুনিয়া আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ। দলের কেউ অপরাধ করলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন