কাপ্তাই হ্রদে বিশাল আকৃতির হাজার হাজার কাচকি জাল (মশারি জাল) দিয়ে মৎস্য শিকারের কারণে হ্রদে বর্তমানে রুই জাতীয় মাছের পরিমাণ ৩ শতাংশে নেমে এসেছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা। পক্ষান্তরে, হ্রদে বাড়ছে কাচকি, চাপিলা ও মলার মতো ছোট ছোট মাছ। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ১৯৬৬ সালে কাপ্তাই লেকে পাওয়া মাছের মধ্যে রুই-জাতীয় মাছের হার ছিল ৮১ শতাংশ। ৫১ বছর পর ২০১৬ সালে এই হার ৪ শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে তা ২ থেকে ৩ শতাংশ বলে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন রাঙামাটি শাখা সূত্র থেকে জানা যায়। ১৯৬৬ সালে লেকে উৎপাদিত মাছের মধ্যে ছোট মাছের হার ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ৯৭ শতাংশে। রুই-জাতীয় মাছ অর্থাৎ রুই, কাতলা, মৃগেলই ছিল কাপ্তাই লেকের প্রাণ। এই মাছগুলোই দিনে দিনে কমে যাচ্ছে কর্ণফুলী হ্রদ তথা কাপ্তাই হ্রদ থেকে।
গবেষণায় ২০০৩ সাল থেকে মাছ উৎপাদনের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ওই বছর লেকে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ৪ হাজার ৫৬৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে রুই-জাতীয় ওই তিনটি মাছের উৎপাদন ছিল ১১৯ মেট্রিক টন। ২০ বছরের ব্যবধানে ২০২৩ সালে এসে মাছের মোট উৎপাদন বাড়লেও রুই জাতীয় মাছের উৎপাদনের হার একেবারেই কমে গেছে।
এই গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট রাঙামাটির বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ। গবেষণায় রুই-জাতীয় মাছ কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে জানিয়ে রিপোর্ট এ বলা হয়, পলি জমে লেকের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে। পানি প্রবাহ না থাকলে রুই-জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে না। তাই আগের মতো মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হচ্ছে না।
এতে বলা হয়, হ্রদের প্রধান চারটি প্রজননস্থল কাসালং চ্যানেল, বরকল চ্যানেল, চেঙ্গী চ্যানেল ও রীংখং চ্যানেল নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে পোনা ও মা মাছ নিধনও এর অন্যতম কারণ। রুই-জাতীয় মাছের হার বাড়াতে হ্রদের তলদেশ খনন, প্রজননস্থলগুলো পুনরায় খননের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং এগুলোকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করার সুপারিশ করা হয়েছে।
শুধু রুই-জাতীয় মাছ নয়, অন্য বেশ কিছু মাছও কমে যাচ্ছে হ্রদ থেকে। ইতিমধ্যে কাপ্তাই হ্রদ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে সিলন, দেশি সরপুঁটি, ঘাউরা, বাঘাইড়, মোহিনী বাটা ও দেশি পাঙাস প্রজাতির মাছ। আর বিপন্ন প্রায় মাছের মধ্যে রয়েছে দেশি মহাশোল, মধু পাবদা, পোয়া, ফাইস্যা, গুলশা ও সাদা ঘনিয়া। ক্রম হ্রাসমান মাছের মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, বাচা, পাবদা ও বড় চিতল অন্যতম।
এদিকে, গতকাল শুক্রবার যোগাযোগ করা হলে রাঙামাটি মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, রাঙামাটির মার্কেটিং অফিসার শোয়েব সালেহীন পূর্বকোণকে জানান, কাপ্তাই হ্রদে বর্তমানে তালিকাভুক্ত ২৭ হাজার জেলে আছে। লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী আছেন ৪৪ জন। মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র আছে চারটি, যথা রাঙামাটি সদর, লংগদু, মারিশ্যারচর ও কাপ্তাই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রে মাছ লোড-আনলোড কাজে জড়িত আছে ১০০ থেকে ১৫০ জন শ্রমিক। পোনা উৎপাদনের জন্য নার্সারি পুকুর আছে আটটি, যথা- রাঙামাটি সদরে ২টি, লংগদু ২টি ও মারিশ্যাচরে ৪টি। এসব নার্সারিতে উৎপাদিত পোনা থেকে এবার মোট ৫৬ টন পোনা মৎস্য শিকার বন্ধ থাকাকালীন সময়ে কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করা হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।
বিএফডিসি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাঙামাটি জেলার ৪টি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মোট ৪৪ টন ৫০০ কেজি মাছ অবতরণ হয় এবং এখানে বিএফডিসি রাজস্ব আয় করে ৯ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। তবে গত বুধবার মোট অবতরণকৃত মাছের পরিমাণ ছিল ৪৮ টন ৮০০ কেজি মাছ। এতে রাজস্ব আয় হয় ৯ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা।
পূর্বকোণ/আরডি