চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪

চা শিল্পে দুর্দিন, কাঙ্ক্ষিত মূল্য নেই নিলাম বাজারে

নিজাম উদ্দিন লাভলু

১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ | ১১:৫২ পূর্বাহ্ণ

চা-বাগানে এখন ভরা মৌসুম। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য বাগানগুলোতে ব্যস্ত সময় পার করছেন চা-শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা। এবার মৌসুমের প্রথম দিকে খরা আর অতিবৃষ্টি  নিয়ে বাগানগুলো মন্দা সময় পার করে। ওই সময়ের বিরূপ আবহাওয়া, তথা অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে গতবছরের চেয়ে এখনও উৎপাদনে পিছিয়ে আছে চট্টগ্রামের ২২টি চা বাগান। এ বাগানগুলোতে গত বছরের তুলনায়  চলতি মৌসুমের আগস্ট মাস পর্যন্ত  প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কেজি চা কম উৎপাদন হয়েছে। তবে  সাম্প্রতিক সময়ের বৃষ্টিতে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা  অর্জনে কিছুটা আশার আলো দেখা দিলেও ঘন ঘন বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে বাগান থেকে তুলে আনা চা-পাতা কারখানাতেই পচে নষ্ট হওয়ার উপক্রম। চায়ের গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কারখানার যন্ত্রপাতি।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, চায়ের এই ভরা মৌসুমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ  প্রয়োজন। অথচ  অবস্থা পুরোপুরি এর বিপরীত।  একটি বাগানের রেকর্ড অনুযায়ী গত জুন-জুলাইয়ে লোডশেডিং ছিল গড়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা, আগস্টে ৬ ঘণ্টা। জুন, জুলাই, আগস্টে দৈনিক সর্বোচ্চ ১১ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের শিকার হতে হয় বাগানগুলোকে। রামগড় চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আমার দৈনিক বিদ্যুৎ চাহিদা ৮০০ কিলোওয়াট। কিন্তু পাচ্ছি ৬০০ কিলোওয়াট। ফলে বিদ্যুৎবিহীন সময়ে কারখানা সচল রাখতে ব্যবহার করতে হয় ডিজেল। প্রতি ঘণ্টায় ডিজেল পুড়ে ৬৫-৭০ লিটার। এখন এক লিটার ডিজেলের দাম ১১৫ টাকা।’ তিনি আরও বলেন, ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে চা তৈরিতে গুণগত মান বজায় রাখা যাচ্ছে না। কারখানার মূল্যবান যন্ত্রপাতিও নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। বাগান কর্মকর্তারা জানান, চায়ের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেলেও নিলাম বাজারে কাঙ্ক্ষিত দাম ওঠেনি। এতে অধিকাংশ চা-বাগানকে লোকসান গুণতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফটিকছড়ির এক চা-বাগান ম্যানেজার বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে  চায়ের  উৎপাদন খরচ  প্রতি কেজি প্রায় ২৫০ টাকা পড়ছে। গত ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের নিলাম বাজারে চায়ের গড় মূল্য ছিল ২০৮ টাকা ৫৮ পয়সা।

 

চা-মৌসুম শুরু হয় মার্চ মাসে। মৌসুমের শুরুর বৃষ্টিকে ‘আশীর্বাদ’ বলে মনে করেন বাগান সংশ্লিষ্টরা । মূলত মার্চের বৃষ্টিতে চা-গাছে কুঁড়ি আসতে শুরু করে। নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত পাতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তবে সর্বোচ্চ চা উৎপাদন হয় জুলাই ও আগস্ট মাসে। এবার মার্চ হতে জুলাই পর্যন্ত বৃষ্টির পরিমাণ ছিল খুবই কম। আবার আগস্টে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশ চা সংসদের  তথ্যমতে,  চট্টগ্রাম অঞ্চলে এবছরের আগস্ট মাসেই বৃষ্টি হয় ৩৬ দশমিক ০১ ইঞ্চি। অথচ বর্ষার শুরু থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়  মাত্র ২৮ দশমিক ৩৩ ইঞ্চি। আর ২০২২ সালের আগস্টে বৃষ্টিপাত হয় ৫ দশমিক ৭১ ইঞ্চি এবং বর্ষার শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত ৩৮ দশমিক ৩২ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। 

 

ফটিকছড়ির অন্যতম বৃহৎ বাগান উদালিয়া চা বাগানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চায়ের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত অত্যাবশ্যক। অনাবৃষ্টিতে যেমন চা উৎপাদন ব্যাহত হয়, তেমনি অতিবৃষ্টিও চায়ের জন্য ক্ষতিকর। চট্টগ্রাম অঞ্চলের এ জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক আরও বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনাবৃষ্টি ও প্রচ- তাপমাত্রার কারণে বাগানগুলোতে এবার ‘রেড স্পাইডার’ ও ‘হেলোফিলিটস মশা’র আক্রমণ ছিল অনেক বেশি। এ মশাগুলো চা গাছের নতুন কুঁড়ি খেয়ে ফেলে।

 

তিনি আরও বলেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ বছর আশানুরুপ চা উৎপাদন হচ্ছে না। গত বছরের উৎপাদনের পরিমাণ থেকে চলিত বছরের এ পর্যন্ত এখনও  বাগানগুলো অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি বলেন, ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত উদালিয়ায় উৎপাদন হয়  ৪ লাখ ৯২ হাজার ৫ কেজি। আর এ বছর হয়েছে ৪ লাখ ৪ হাজার ৩৪৬ কেজি। যা  গত বছরের তুলনায় প্রায় ৮৮ হাজার কেজি কম। চা সংসদের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের ২২টি চা বাগানের সবগুলোরই একই অবস্থা। যেমন, ফটিকছড়ির কর্ণফুলি বাগানে উৎপাদন কমেছে এক লাখ ২ হাজার ৮০৫ কেজি, নেপচুনে ৭০ হাজার ৩০৭ কেজি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ফটিকছড়ির একটি চা বাগানের মালিক বলেন, বিরূপ আবহাওয়া, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংকট, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও শ্রমিক মজুরিসহ সর্বক্ষেত্রে ব্যয়বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েগেছে। কিন্তু নিলাম বাজারে চায়ের  কাক্সিক্ষত দাম বাড়েনি। ফলে বাগান পরিচালনায় মালিকদের চরম হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে ১৪০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের  সরকারের যে পরিকল্পনা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।  যেসব কারণে চা শিল্প এখন হুমকিরমুখে, সেগুলো পরিত্রাণ বা উত্তরণে  সরকারের জরুরি  পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলেও জানান ওই বাগান মালিক। 

 

পূর্বকোণ/আরডি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট