চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

গলায় আটকে যাওয়া কয়েন বের করেন ডা. শোভন

চকরিয়ায় শিশুর গলায় আটকে যাওয়া কয়েন ১৫ মিনিটেই উদ্ধার

এম জাহেদ চৌধুরী

১২ জুলাই, ২০২৩ | ১২:০৬ অপরাহ্ণ

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর শাপলাপুর এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জমির উদ্দিন। ব্যবসার কাজে তিনি ছিলেন ঘরের বাইরে। স্ত্রী গৃহস্থালির কাজ করছিলেন। ঘরের করিডোরে একাই খেলছিলো তাদের দুই বছর বয়সী কন্যাসন্তান রাফিয়া আক্তার। খেলার ফাঁকে খুঁজে পাওয়া এক টাকা মূল্যের ধাতব কয়েন খেলার ছলে মুখে নিলে খাদ্যনালীতে আটকে যায়। কেউ জানতো না কি হয়েছে রাফিয়ার। গত ১ জুলাই কয়েন আটকে যাওয়ার পর খাওয়া বন্ধ হয়ে যায় রাফিয়ার। ব্যাঘাত ঘটতে শুরু করে শ্বাসপ্রশ্বাসে। কান্নাকাটি বাড়তেই থাকে ক্রমান্নয়ে। শিশু সন্তানের করুণ অবস্থা দেখে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায় মা-বাবা। রাফিয়ার হঠাৎ অস্বস্তির কারণ খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠে তারা। সন্তানকে নিয়ে স্থানীয় বিভিন্ন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হলেও কোন কূলকিনারা মেলেনি তিন দিনেও। নিকটাত্মীয়দের পরামর্শে ছুটে যান কক্সবাজার শহরস্থ একটি নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে। ৩ জুলাই ওই হাসপাতালে ভর্তি করান সন্তানকে। এক্স-রে করে ধরা পড়ে রাফিয়ার খাদ্যনালীর (ইসুফেগাস) উপরিভাগে একটি কয়েন আটকে শ্বাসনালীর (ট্রাকিয়া) সামনে চাপ সৃষ্টি করায় শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটছে। কয়েনটি বের করতে ২৫ হাজার টাকার চুক্তিতে শুরু হয় চিকিৎসা। দুই জন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ সার্জন ও একজন এনেসথেশিওলজিস্ট দিনরাত চেষ্টা করেও কয়েন বের করতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে ১১ হাজার টাকা নিয়ে সেখান থেকে ৪ জুলাই রেফার করা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

 

বাবা জমির উদ্দিন বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে  স্ত্রীসহ আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয় আমাদের। মেয়ের শরীরও নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলো। কক্সবাজার সদরের ওই হাসপাতাল থেকে বের হয়ে চট্টগ্রাম নিতে গাড়ি ভাড়া নিতে দরদাম করছিলাম। এসময় হঠাৎ অপরিচিত এক ব্যাক্তি জানায়, ‘চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার শোভন দত্ত এমন অনেক রোগী ভালো করেছেন।’ এ কথা শুনেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে না নিয়ে যাত্রা শুরু করি চকরিয়ায়। পৌঁছেই জানতে পারি চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে সরকারি হাসপাতালে নয়, নিকটস্থ বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতাল লিমিটেডে চিকিৎসা দেবেন ডাক্তার শোভন। ওইদিন বিকেলে দেখা মেলে তার। সন্তানের চিকিৎসার বিষয়ে কথা হয় তার সাথে। সন্ধ্যায় কয়েন বের করার সিদ্ধান্ত হয়। ওইসময় সন্তানকে নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম আমরা। ভয় আরো বেড়ে যায় মেয়েকে অজ্ঞান করার আগে স্বাক্ষর নেয়ায়। তবে সেই ভয়ের চরম মুহূর্ত কেটে যায় মাত্র ১৫ মিনিট পরেই। যেন প্রাণ ফিরে পাই আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই। আনন্দে কাঁদছিলাম গলা থেকে বের করা ১ টাকার ধাতব কয়েনটি হাতে নিয়ে।’

 

কয়েন বের করার বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক্তার শোভন দত্ত বলেন, ‘সর্বশেষ মুহূর্তে একটি এক্স-রে পরীক্ষার মাধ্যমে কয়েনটির অবস্থান শনাক্ত হওয়ার পর বাচ্চাটির শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়। শ্বাসনালীতে টিউব স্থাপন করে কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস সচল রেখে মাংসপেশী রিলাক্স করার ওষুধ প্রয়োগ করার মাধ্যমে খাদ্যনালী প্রসারিত করে ল্যারিঙ্গোস্কোপ নামক বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে দেখে ম্যাগিলস্ ফরসেপ নামক  বিশেষ ভোতা ফরসেপ্ যন্ত্রের সাহায্যে কয়েনটি সাবধানে বের করতে সক্ষম হই।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘২০২১ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনেসথেশিওলজিস্ট বিশেষজ্ঞ ডিগ্রী লাভ করি। এরপর প্রায় দুই বছরে চকরিয়ায় অন্তত ৫০ জন শিশুর খাদ্যনালী থেকে কয়েন পেরেক, হাড়, কাটা, ক্লিপ, কানের দুল বের করতে সফল হই। এই সফলতা লোক মুখে আশপাশে জানাজানি হলেও ব্যাপক প্রচারণায় আসেনি।’

 

এদিকে পেকুয়ার রেজাউল করিম মানিক বলেন, ‘গত কোরবানির দিন ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে পশু জবাইয়ের প্রাক্কালে আমাদের পরিবারের আনন্দ মিইয়ে যায় আমার তিন বছর বয়সী শিশু সন্তান আব্দুর রহমানের গলায় ৫ টাকা মূল্যের ধাতব কয়েন আটকে পড়ায়। ফলে, ওইদিন কোরবানির আয়োজন স্থগিত রেখে শ্যালক মইনুল ইসলামের পরামর্শে ছুটে যাই চকরিয়ার ডাক্তার শোভন দত্তের কাছে। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েন বের করে আমাদের পরিবারের স্বস্তি ফিরিয়ে দেন।’

 

অনুরুপভাবে, ৩ জুন আড়াই বছর বয়সী আনাফ, ২৩ এপ্রিল দিনা (৯), ১৬ এপ্রিল তানিয়া (২), ৩ জানুয়ারি আব্দুল্লাহ (৫), গত বছরের ১ নভেম্বর ইয়াসির (২) এর খাদ্যনালী মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে কয়েন বের করে পরিবার সদস্যদের স্বস্তি ফিরিয়ে দেন ডাক্তার শোভন।

 

ডাক্তার শোভন বলেন, ‘চকরিয়া সরকারি হাসপাতালে প্রশিক্ষিত সহকারী ও পরীক্ষা সরঞ্জাম দেয়া হলে, এ ধরণের রোগীকে ছুটতে হবে না বেসরকারি হাসপাতালে। নামমাত্র খরচে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যাবে।’

পূর্বকোণ/পিআর

শেয়ার করুন