চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

মংডু ঘুরে এলো ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল

টেকনাফ সংবাদদাতা

৫ মে, ২০২৩ | ১১:৩২ অপরাহ্ণ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে এলো বাংলাদেশে বসবাসরত ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল।

 

শুক্রবার (৫ মে) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফের ট্রানজিট জেটিঘাট দিয়ে ২৭ সদস্যর প্রতিনিধি দলটি নৌপথে স্পীডবোটযোগে রওনা দিয়ে বিকালে ফিরে আসে।

 

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা।

 

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা জানা যায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা ২০ জন রোহিঙ্গা সদস্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্ন সচিব) মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে আরও ৭ জন কর্মকর্তাসহ মোট ২৭ জনের একটি প্রতিনিধি দল পরিদর্শনের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য মংডুর টাউনশীপ (আইডিপি) ক্যাম্পে নৌ-পথে শুক্রবার সকালে টেকনাফের জালিয়াপাড়া জেটিঘাট দিয়ে রওনা করেন। প্রতিনিধি দল সেখানে ১৫ টি গ্রাম সরেজমিনে পরিদর্শন করে।

 

এর আগে, গত ১৫ মার্চ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের ১৭ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল টিম কর্তৃক সাক্ষাৎকার গ্রহণ নেন সাত দিনে ১৪৭টি পরিবারের প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ তারা ফিরে যান।

 

রওনা হওয়ার আগে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, প্রতিনিধি দলটি বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ‘রাখাইনের সার্বিক পরিস্থিতি কতোটুকু অনুকূলে’ তা দেখতে মিয়ানমার যাচ্ছে। মূলতঃ প্রতিনিধি টিম ‘গো সি এন্ড ভিজিট’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর ও আশপাশের গ্রাম, স্থাপনা পরিদর্শন করবেন।

 

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. মিজানুর রহমান মিয়ানমার ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ছাড়া বাংলাদেশের সমস্যা শেষ হবে না। ৭০ বছরের সমস্যা একদিনে শেষ হওয়ার কথা না। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা অনেক আন্তরিক বলে মনে হয়েছে। আমাদের ‘গো সি এন্ড ভিজিট’ দাবির প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের মংডু ও আশপাশের গ্রাম, স্থাপনা দেখানোর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের আস্থা ফিরাতে চায়। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলে টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা তিন জন নারী এবং ১৭ জন পুরুষ রয়েছেন। তারা সবাই প্রত্যাবাসনের জন্য যাচাই-বাছাই করে মিয়ানমারের তৈরি রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্ত।

 

প্রতিনিধি দলের হয়ে যেসব রোহিঙ্গা রাখাইনে যাচ্ছেন, তারাই মূলত মূখ্য ভূমিকা পালন করবেন। সেখানে (রাখাইন রাজ্য) প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি অবকাঠামোসহ অন্যান্য ব্যবস্থা প্রতিনিধি দলের সদস্য রোহিঙ্গারা স্বচক্ষে দেখবেন। যেহেতু রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হবে, তাই তাদের সরেজমিন অভিজ্ঞতা প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দলটি রাখাইনের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে আশ্বস্থ হলে তা প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক হবে’।

 

এদিকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করা প্রায় ২২০ পরিবারের মধ্য থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত টেকনাফ ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ১৪ পরিবার, ২৭ নম্বর ক্যাম্পের ৪ পরিবার ও ২৪ নম্বর ক্যাম্পের ২ পরিবারসহ মোট ২০টি পরিবারের ৩ জন নারী সদস্যসহ ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি করিম উল্লাহ, মো. সেলিম, রশিদ উল্লাহ. ছৈয়দ আলম, অলি হোসেন, মো. ফারুক, মোহাম্মদ ইলিয়াস, সাঈদ আলম, আবুল হোসেন, আবু সুফিয়ান, আবু তৈয়ব, মো. ইলিয়াস, নোমান, মো. তাহের, মো. আলম, আবু সামা, আবদু সালাম, জমিলা, রহিমা খাতুন ও সুবিয়া খাতুন স্পিডবোটযোগে মংডু ঘুরে আসেন। নিজ দেশের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে এসে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি জমিলা, আবু সুফিয়ান, করিম উল্লাহ সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন।

 

তারা জানান, ‘নিজ গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে অবশিষ্ট নেই। কিছু ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে আমাদের রাখার জন্য। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আমাদের নাগরিকত্ব ও জমিজমা বসতভিটা নিয়ে কোন সদুত্তর দেননি। এভাবে আমরা সেখানে কীভাবে ফিরে যাবো?

 

টেকনাফ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান জানান, প্রত্যাবাসনের পরিস্থিতি দেখতে রাখাইনে রাজ্য মংডুতে রোহিঙ্গা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও-আরআরসি প্রতিনিধি সহ একটি টিম মিয়ানমারের মংডু সফর করেছেন।

 

চীনের মধ্যস্থতায় চলতি মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর প্রচেষ্টা চলছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের আগেই রাখাইনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানোর প্রস্তাব করে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও এবার রাজি হয়েছে মিয়ানমার। এরই প্রেক্ষিতে ৫ মে প্রতিনিধি দলটিকে রাখাইনে পাঠানোর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল। রাখাইনে কী পরিমাণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়েছে কিনা, তা রোহিঙ্গা প্রতিনিধি দল নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করলেন।

 

এর আগে গত ১৫ মার্চ টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমার সরকারের ১৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা নাগরিকদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তারা বাংলাদেশের দেওয়া রোহিঙ্গাদের তালিকা যাছাই-বাছাই করেন। মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি টানা সাতদিন টেকনাফের স্থলবন্দর রেস্ট হাউজে অবস্থান করে বাংলাদেশে আশ্রিত ১৪৭ রোহিঙ্গা পরিবারের মোট ৪৮৬ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। আর তাদের দেওয়া বক্তব্য রেকর্ড করেন। ২২ মার্চ সকালে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলটি নাফ নদী পার হয়ে মিয়ানমারে ফিরে যায়। সে সময় মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যাদের প্রত্যাবাসন করা হবে সেই সব রোহিঙ্গা যাতে আগে থেকে রাখাইনের সার্বিক পরিবেশ দেখে আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা, নয়াপাড়া ও জাদিমুড়া এলাকায় ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২০ জন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে বাছাই করা হয়।

 

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই হত্যা ও নির্যাতনকে চিহ্নিত করেছিল ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদী উদাহরণ’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চলতি বছরের মার্চে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো ওই হত্যাযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে টেকনাফ ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বাঁশ আর প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার একপর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।

 

এরপর আসে করোনা ভাইরাস মহামারী। রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সঙ্কটের মধ্যেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে। সেই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকারে রাখা বাংলাদেশ সরকার বারবার অভিযোগ করে আসছে আন্তর্জাতিক মহল প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের এক বছরের মাথায় গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে নবগঠিত ‘অ্যাড-হক টাস্কফোর্স ফর ভেরিফিকেশন অব দ্য ডিসপ্লেসড পার্সনস ফ্রম রাখাইন’ এর বৈঠক হয়। এরপর গত বছরের ১৪ জুনে হয় দুদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব চ্যান আয়ে বৈঠকে নিজ দেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।

 

পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ

শেয়ার করুন