চট্টগ্রাম শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪

সর্বশেষ:

পাহাড়ি-বাঙালির তীর্থস্থান পাহাড়তলী মহামুনি মন্দির

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৪:৩৫ অপরাহ্ণ

শতশত বছরের পুরনো রাউজানের পাহাড়তলী মহামুনি মন্দির পাহাড়ি -বাঙালিদের তীর্থস্থান। এ মন্দিরের ঐতিহ্য, নান্দনিক সৌন্দর্য মন কাড়ে যে কারো। প্রতিবাংলা বছরের চৈত্র সংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখকে ঘিরে এখানে মিলন মেলা ঘটে পাহাড়ি-বাঙালির।

 

পার্বত্য অঞ্চলের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ বিভিন্ন জেলা উপজেলার পাহাড়ি-বাঙালি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নারী-পুরুষ পুরনো বছরকে বিদায় ও নববর্ষকে বরণ করতে মহামুনি মন্দিরে আসেন। এখানে সপ্তাহ বা কয়েকদিন-ব্যাপী মেলা বসে। আয়োজন হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংবর্ধনা, ধর্মী আলোচনাসহ নানা কর্মসূচি। আচার অনুষ্ঠান সারতে এখানে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল ফণীতটি মঞ্চ। পাহাড়ের কোলে গড়া শতশত বছরের এ মহামুনি মন্দিরের নানা অবকাঠামো উন্নয়নের কারণে এটি বেশ কয়েক বছর ধরে নান্দনিক রূপ ধারণ করেছে। মেলা-পার্বণে পাহাড়ি-বাঙালিদের পাশাপাশি মুসলিম-হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও উৎসবে সামিল হন। শুধু পার্বণে নয়, এই মহামুনি মন্দির দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন নানা শ্রেণির মানুষ। এ মন্দিরে দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এখানে রয়েছে বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি।

 

বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে ও ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, এ মন্দিরে ‘মহামুনি’ অর্থাৎ মহামানব গৌতম বুদ্ধের মূর্তি স্থাপিত বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘মহামুনি মন্দির’। মন্দিরটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়েছে মূর্তিটির জন্য এবং একে ভিত্তি করে বৌদ্ধ ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে মহামুনি গ্রাম পবিত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধে (আনুমানিক ১৭৮০ খৃষ্টাব্দ) চট্টগ্রাম  জেলার রাউজান উপজেলার কদলপুর তথা, মহামুনি গ্রামের প্রাজ্ঞ বৌদ্ধভিক্ষু চাঁইঙ্গাঠাকুর প্রকাশ চাঁইঙ্গ ঠাকুর ধর্মদর্শনে শিক্ষা লাভের জন্য বার্মা বর্তমান মিায়ানমার যান এবং শিক্ষাশেষে তীর্থস্থান ভ্রমণোপলক্ষে আরাকান (অপর নাম রোসাঙ্গ) আসেন। আরাকানের ম্রিহং গেলে সেখানকার ‘মহামুনি মূর্তি’ দেখে তিনি এতই অভিভূত হন যে নিজ গ্রামে ‘মহামুনি মূর্তি’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন। লোকমুখে শোনা যায় এক সময় গৌতম বুদ্ধ আরাকান এসেছিলেন। তাঁকে দেখে শিল্পীরা স্মৃতি থেকে তার মূর্তি তৈরি করেন। বলা হয়ে থাকে মূর্তিটি গৌতম বুদ্ধের মূল চেহারার সাথে সম্পূর্ণ মিল ছিল। ম্ধসঢ়;বিহং-এ স্থাপিত হয়েছিল বুদ্ধের সেই মূর্তিটিই। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় চাঁইঙ্গা ঠাকুর সেদেশের শিল্পী দ্বারা আরাকানের মহামুনি মূর্তির একটি ছবি অংকন (মতান্তরে, অনুরূপ একটি পিতলের নমুনামূর্তি) করে নিয়ে আসেন। স্ব গ্রামবাসীর সম্মতি ও সহযোগিতায় আরাকান থেকে কারিগর সংগ্রহ করে সুদক্ষ ভাস্কর দ্বারা এক বছরের মধ্যে ১৮০৫ সালে মতান্তরে ১৮১৩ সালে আরাকানের মহামুনি মূর্তির আদলে সুউচ্চ বৃহদাকারের বুদ্ধমূর্তি নির্মাণ করেন। যা’ একটি বাঁশের বেড়া ও খড়ের চাল বিশিষ্ট ঘরে স্থাপন করা হয়। মূর্তিটির জন্য গ্রামটির নাম হয়ে যায় ‘মহামুনি’। স্থানটির চারদিকে পাহাড় ঘেরা ও জনবসতি পাহাড়ের ছায়ায় মহামুনিতে মূর্তিটি স্থাপন সম্পর্কে একটি প্রবাদ বাক্য প্রচলন আছে, তা হচ্ছে-‘ছোট মোড চাঁইঙ্গা ঠাকুর এত বুদ্ধি জানে রোসাং থেকে মহামুনি কদলপুরে আনে’। তখনকার সময়ে পাহাড়তলি ইউনিয়ন কদলপুরের সাথে সংযুক্ত ছিল। খড়ের চালা বিশিষ্ট বাশের  তৈরি যে ঘরটিতে প্রথম চাঁইঙ্গা ঠাকুরের উদ্যোগে নির্মিত বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপন করা হয়েছিল সেটি হঠাৎ আগুন লেগে ভস্মীভূত হওয়ায় পরবর্তীতে মানরাজাদের বংশধর কক্সবাজার জেলার পালং ধনীপ্রবর কুঞ্জ ধামাই এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি পাকা মন্দির নির্মাণ করে সেখানে বুদ্ধ মূর্তিটি স্থাপন করেন। ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে কুঞ্জ ধামাইর পুত্র মানরাজা কেইজ চাইং চৌধুরী মূল মন্দিরের চারকোণে চারটি গম্বুজসহ চারদিকে বারান্দা এবং একটি তোরণও নির্মাণ করেন। মং সার্কেলের (রাজধানী মানিকছড়ি) রাজা ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে মহামুনি মন্দির চত্বরে মহামুনি মেলার প্রবর্তন করেন, যা বাংলা সনের চৈত্র মাসের শেষ তারিখে শুরু হয়। এ মেলা প্রতি বছর বাঙালি। বৌদ্ধ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীসহ সকল সম্প্রদায় ও শ্রেণির একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়। মেলা প্রাঙ্গণে এ গ্রামের সংগঠনসমূহের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন মহামুনির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মন্দির ও মহামুনি বিগ্রহ স্থাপন উপলক্ষে বৌদ্ধ নর-নারীদের আগমনে সুপেয় পানীয় জলের জন্য কেইজ চাইং কুঞ্জ ধামাইর উত্তরাধিকার তৎকালীন মংরাজা মহামুনি মন্দিরের কাছাকাছি এক দিঘি খনন করেন যা ‘ধামাইর দিঘি’ নামে পরিচিত। কুঞ্জ ধামাইর উত্তরাধিকার তৎকালীন মংরাজা মহামুনি টিলা ও মহামুনি মন্দির ধর্মীয় বিধান মতে বৌদ্ধ জনসাধারণ ও পার্বত্য জেলার রাজপরিবারের পূর্বসুরীদের হিতার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের সমতল এলাকার নিমন্ত্রিত ভিক্ষুসংঘের সমবেত দান কার্যাদির মাধ্যমে এ মন্দির ও তৎসংলগ্ন চত্বর উৎসর্গ করেন। কালের ঘাত-প্রতিঘাতে মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন স্থাপনাসমূহের সৌন্দর্যহানি ও জীর্ণ-শীর্ণ এবং এর অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ায় মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামের সর্বসাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ‘মহামুনি মন্দির উন্নয়ন ও সংরক্ষণ কমিটি’ সকলের সহযোগিতায় ২০০৮ সনে মহামুনি মন্দিরটি এবং তৎসংলগ্ন চত্বর উন্নয়ন সংস্কার ও আধুনিকায়নের এক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। এতে মহামুনি গ্রামের সন্তান লায়ন রূপম কিশোর বড়–য়ার অগ্রণী ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে এলাকাবাসী জানান। কমিটির উদ্যোগে ও আগ্রহী দাতাদের অর্থায়নে ২০১২ সনে মহামুনি মন্দির চত্বরের পূর্বাংশে নির্মিত অষ্টবিংশ বুদ্ধ মন্দিরের সমাহার মন্দির চত্বরকে আরো বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। মন্দিরের সম্মুখে অশ্বত্থ বৃক্ষের পাশে স্থাপিত লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট্ ডিগ্রিধারী এ গ্রামের সুসন্তান বিশ্বমনীষা ড. বেণীমাধব বড়ুয়ার আবক্ষমূর্তি মহামুনি মন্দির চত্বরকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। ফলে, মন্দির ও মন্দির চত্বর এখন চিত্তাকর্ষক তীর্থস্থান ও দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন