চট্টগ্রাম রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সর্বশেষ:

দেওয়ানহাট খাদ্য গুদাম

গুদাম রক্ষকেরাই বড় ‘ভক্ষক’

মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

২০ মার্চ, ২০২৪ | ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

খাদ্য গুদামের দেয়ালে দেয়ালে যেন লুকিয়ে রয়েছে বিশাল বিশাল ‘ইঁদুর’। সরকারি খাদ্যশস্য মজুদ ও নিরাপদ বিলি-বন্টন হয় বিভিন্ন খাদ্য গুদাম থেকে। কিন্তু সেই গুদাম পাহারাদাররাই যদি ইঁদুরের মতো সরকারি চাল চেটেপুটে ধ্বংস করতে থাকে তাহলে সরকার কী করবে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ স্থাপনাটি তখন অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। তেমননি বড় ধরনের অনিয়ম ও চাল চালাচালির অভিযোগ উঠেছে দেওয়ানহাট খাদ্য গুদামে।

নগরীর দেওয়ানহাট ও হালিশহর খাদ্য গুদাম হচ্ছে দেশের অন্যতম বড় গুদাম। সারাদেশ থেকে খাদ্যশস্য সরবরাহ করা হয় এই দুটি গুদাম থেকে। দীর্ঘদিনের অভিযোগ, দুটি গুদামের সরকারি চাল নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম চলে আসছে। খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সরকারি চাল নিয়ে চলছে যাচ্ছেতাই। ভালো ও উন্নতমানের চাল টাকার বিনিময়ে চলে যায় কালোবাজারিদের হাতে। সাম্প্রতিকসময়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় চালবাজির ঘটনা বেশি ঘটেছে। টাকার বিনিময়ে সিদ্ধচালের বদলে আতপ চাল সরবরাহ এবং ভালোমানের চাল কালোবাজারিদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে চেকপোস্ট ইনচার্জকে বদলি করে দায় সেরেছেন বড় কর্তারা।

খাদ্য বিভাগ সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে নগরের দেওয়ানহাট খাদ্য গুদামে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছুটিতে থাকার সুযোগে কর্মকর্তারা মিলেমিশে কেটেকুটে খেয়েছে। আঞ্চলিক কর্মকর্তা ছুটি শেষে যোগদান করার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেন। চেকপোস্ট ইনচার্জ ফরমান উল্লাহকে সরিয়ে আবদুল হাই নামে আরেকজনকে ওই পদে পদায়ন করা হয়েছে।
সিদ্ধচালের বদলে আতপ চাল : চট্টগ্রাম অঞ্চলের আতপ চালের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সারাদেশে সিদ্ধচালের চাহিদা বেশি। সরকারি খাদ্য গুদামে আতপ চালের জোগান সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম মজুদ থাকায় আতপ চালের সরবরাহ কিছুটা সীমিত করেছে। কিন্তু খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তারা যোগসাজশে যাচ্ছেতাইভাবে আতপ চাল সরবরাহ দিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, দেওয়ানহাট সিএসডি গুদাম মজুদ ইনচার্জ ও উপ-খাদ্য পরিদর্শক পাপ্পু ঢালী যেন উদার হস্তে ঢেলে দিয়েছেন। পাপ্পু ঢালী প্রায় ১০ বছর ধরে এক চেয়ারে কর্মরত আছেন বলে জানা যায়। পদোন্নতি পাওয়ার পরও একই চেয়ারে খুঁটি গেড়ে রয়েছেন তিনি।

 

একাধিক সূত্র ও পরিবহন ঠিকাদার সূত্র জানায়, গত ১৫ মার্চ নগরের ৫ জন ওএমএস ডিলারকে সিদ্ধচালের বদলে ছয় টন আতপ চাল সরবরাহ করা হয়। কেজিপ্রতি ৩-৫ টাকার বিনিময়ে ভালোমানের চাল সরবরাহ করেছেন পাপ্পু ঢালী। শুধু তাই নয়, তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন খাদ্য গুদামেও একই ধরনের জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত তিন মাস ধরে (জানুয়ারি থেকে মার্চ) পর্যন্ত বেপরোয়াভাবে চাল নিয়ে চালাচালি করার অভিযোগ রয়েছে।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপ-খাদ্য পরিদর্শক ও দেওয়ানহাট সিএসডি মজুদ ইনচার্জ পাপ্পু ঢালী গতকাল পূর্বকোণকে বলেন, ‘এমন কোনো কিছু হয়নি। আপনারা সব জানেন। সময় করে অফিসে আসেন, একসঙ্গে বসে সব বলবো।’

 

শুভঙ্করের ফাঁকি : খাদ্য গুদামের চাল নিয়ে অনিয়ম ও পাচারের বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেন খাদ্য ও গুদাম কর্মকর্তারা। ওএমএস ডিলার ও তিন পার্বত্য জেলা এবং চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন গুদামে চাল সরবরাহের সময় ‘ইনভয়েস’ ও ‘ডিওতে’ চালের ধরণ (আতপ বা সিদ্ধ) লিখা হয় না। শুধু চাল লিখা হয়, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে কারসাজির চিত্র ধরা না পড়ে।
নগরের দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামে।

 

গুদাম কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট : দেওয়ানহাট ও হালিশহর কর্মকর্তাদের সাথে চট্টগ্রাম অঞ্চলের গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশ দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিকসময়ে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছুটিতে থাকার সুবাধে তিন পার্বত্য জেলায় দেদারছে অনিয়ম হয়েছে। রাঙামাটি সদর, পানছড়ি, আলী কদম, রামগড়, গুইমারা খাদ্য গুদামে সিদ্ধচালের পরিবর্তে বেশি আতপ চাল সরবরাহ করা হয়েছে। গুদাম কর্মকর্তাদের (ওসিএলএসডি) সঙ্গে দেওয়ানহাট ও হালিশহর গুদাম কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব আতপ চাল ঘুরেফিরে কালোবাজারিদের হাতে পৌঁছে গেছে।

 

দেওয়ানহাট খাদ্য গুদামে ৬৪টি গুদাম রয়েছে। কোন গুদামে কী পরিমাণ চাল রয়েছে, কী পরিমাণ চাল সরবরাহ করা হয়েছে তার কয়েকটি তথ্য পূর্বকোণের কাছে সংরক্ষণ রয়েছে। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসের একটি সূচি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মানিকছড়ি, তবলছড়ি, বদরখালী, আলীকদম, দিঘিনালা, গুইমারা, রামগড়, পানছড়ি, রাঙামাটি খাদ্য গুদামে সিদ্ধচাল সরবরাহ করার কথা ছিল। এতে ডিও ও বিলি শাখার ইনচার্জ পাপ্পু ঢালীর স্বাক্ষর রয়েছে। কিন্তু এসব গুদামে সিদ্ধচালের বদলে কালোবাজারিদের সঙ্গে আঁতাত করে আতপ চাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিকেজি চালের জন্য কালোবাজারিদের কাছ থেকে ৩-৫ টাকা করে নেওয়া হয়।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আঞ্চলিক খাদ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব চাল তো চলে গেছে। তা বিলি-বন্টনও হয়ে গেছে। অভিযোগ পাওয়া গেলেও তদন্ত করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

জানতে চাইলে দেওয়ানহাট সিএসডি গুদামের সহকারী ম্যানেজার নাসির উদ্দিন বলেন, ‘সময় করে অফিসে আসেন। কথা হবে।’

 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই ডিও ব্যবসায়ী জানান, ‘আগে হালিশহর ও দেওয়ানহাট থেকে ডিও’র বিপরীতে সরবরাহ চাল সরাসরি বাজারে নেওয়া হতো। নতুন আঞ্চলিক কর্মকর্তা যোগদানের পর সেই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। সিএসডি গুদাম থেকে চাল বের হওয়ার এবং এলএসডি গুদামে পৌঁছানো পর্যন্ত ১০ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্র পাঠাতে হয়। ১০ সেকেন্ডের ভিডিওচিত্র পাঠানোর কারণে কালোবাজারি অনেকটা কমে যায়। এখন গুদাম কর্মকর্তাদের হাত করে ঘুরেফিরে একই ট্রাকে চাল কালোবাজারে চলে আসছে।

 

নওগাঁ, দিনাজপুর, নেত্রকোণা ও আশুগঞ্জের চালের মান ভালো। এসব অঞ্চলের চালের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি থাকে চাল ব্যবসায়ী চক্রের। এসব অঞ্চলের চালের কদর বেশি থাকে কালোবাজারিদের কাছে।

 

২০২১ সালে এই দুটি গুদামে এই ধরনের বড় অভিযোগ ছিল। তৎসময়ে খাদ্যমন্ত্রী চট্টগ্রাম আসলে দেওয়ানহাট সিএসডির ১০টি গুদাম সিলগালা করেছিলেন। ওই সময়ের অভিযোগ ছিল, খাদ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে কালোবাজারিরা গুদামের ভেতরেই সরকারি চালের বস্তা বদলে নিজের ব্র্যান্ডের বস্তায় চাল ভরা হয়। সেই চাল সুবিধামতো সময়ে ডিও’র বিপরীতে গুদাম থেকে বের করে সোজা কালোবাজারিদের গুদামে পৌঁছে যেত। দৈনিক পূর্বকোণ ‘চাল চালাচালিতে ‘সাগরচুরি’, ‘দুই ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে সরকারি গুদামের চাল’, ‘বিড়াল দিয়ে শুঁটকি পাহারা’-শিরোনামে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

পূর্বকোণ/পিআর 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট