
২০০৮ সালের ডিজিটাল কারচুপির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের সূচনা ঘটে। তখন থেকেই রাষ্ট্রব্যবস্থার দলীয়করণ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একনায়কতন্ত্রের রূপরেখাটি পরিপূর্ণ রূপ পায় ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের মধ্যরাতের ভোট ডাকাতি এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের প্রহসনের ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি নির্বাচনেই দেশের জনগণ তাদের প্রকৃত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। নতুন প্রজন্ম বিশেষকরে, যাদের জন্ম ২০০০ সালের পরে তারা কখনোই একটি প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক, নিরেপক্ষ নির্বাচন দেখতে পায় নি। কারণ, স্বৈরাচারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনেই বিরোধী দলগুলোর জন্য ছিল না নির্বাচনী লড়াইয়ের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিচারব্যবস্থা ছিল দলীয় নিয়ন্ত্রণাধীন। রাষ্ট্রকাঠামোকে তাদের অনুগত যন্ত্রে পরিণত করে দেশে একদলীয় শাসনের পরিবেশ তৈরি করা হয়।
এই দীর্ঘকালীন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে ক্রমে জমতে থাকে ক্ষোভ ও বেদনা। বিশেষত, সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা, মেধা ও যোগ্যতার অবমূল্যায়ন এবং এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করলেই দমন-পীড়নের সংস্কৃতি জনগণের মনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করে। মানুষ জেগে উঠলে ইতিহাস বদলায়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্য দৃঢ় করা যায়। এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান। ২০২৪ সালের ১ জুলাই শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা করে, তা ধীরে ধীরে রূপ নেয় একটি গণঅভ্যুত্থানে। এটি প্রথমে ছিল একটি নীতিনির্ভর প্রতিবাদ, পরে তা হয়ে ওঠে বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ভোট ডাকাতি, গুম-খুন, দুর্নীতি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধের রূপ। ৩৬ দিনের একটানা আন্দোলনের পর ৫ আগস্ট ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের মুখে শেষ পর্যন্ত জনগণের প্রতিরোধই জয়ী হয়, শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এটি ছিল শুধু একজন স্বৈরশাসকের পতন নয় বরং জাতির এক ঐতিহাসিক জাগরণের প্রতীক।
সরকারি হিসাবে প্রায় নয়শ জনের প্রাণহানি এবং প্রায় পনের হাজারের বেশি আহতের (জাতিসংঘের হিসাবে প্রায় দেড় হাজারের প্রাণহানি এবং হাজারে হাজার আহত) মধ্য দিয়ে সফল পরিণতি পাওয়া এই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে আসে দৃশ্যমান পরিবর্তন। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এক ধরনের পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষতা ফিরে আসে। বহুদিন পর দেশের মানুষ ফিরে পায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে সক্রিয় হয়, গণমাধ্যমে ফিরে আসে তর্ক-বিতর্কের প্রাণচাঞ্চল্য। তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়ে হয়ে উঠে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন ও সক্রিয়। এখন মানুষ রাজনীতিকে দলীয় মতাদর্শ কিংবা নির্বাচন নয় বরং নিজেদের নায্য অধিকার এবং ন্যায়ের প্রশ্নে গুরুত্ব দিতে শিখছে। পররাষ্ট্রনীতিতেও দেখা যায় একটি দৃঢ় ও আত্মমর্যাদাশীল অবস্থান। নতুন সরকারের আমলে সীমান্তে হত্যার ঘটনা কমে আসে, আন্তর্জাতিক পরিসরে আর আগের মতো নতজানু পররাষ্ট্রনীতি চোখে পড়ে না এখন।
সব অর্জনের মাঝেও কিছু হতাশা রয়ে গেছে। স্বৈরাচার পতনের আজ এক বছর পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত তার শাসনামলে সংঘটিত গুম, খুন, ভোট কারচুপি বা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি। বরং অনেকক্ষেত্রে সরকার এখন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রক্রিয়া চলছে ধীরগতিতে এবং একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের রোডম্যাপ এখনও জাতির সামনে স্পষ্ট নয়। ফলে জনমনে প্রশ্ন জাগছে এই অভ্যুত্থান কি কেবল স্বৈরাচারের পালায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি এটি সত্যিকার অর্থে একটি নতুন রাষ্ট্রচেতনার ভিত্তি গড়বে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে জাতির বর্তমান করণীয়ের উপর। আমাদের সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন এখন একটি সর্বজনীন জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা যার ভিত্তিতে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব হবে, যেখানে জনগণ প্রকৃত অর্থে সরকার নির্বাচন করতে পারবে। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন থাকতে হবে, যাতে করে কোনো রাজনৈতিক শক্তি, বিশেষত আগের মতাদর্শগত আধিপত্য বিস্তারকারী দল, পুনরায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করতে না পারে। আওয়ামী লীগের মত একদলীয় শাসনব্যবস্থার পুনর্বাসন যেন কোনোভাবেই না ঘটে, এ বিষয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ালে বিজয় আসে। তবে সেই বিজয়কে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন হয় নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম, ঐক্য ও রাজনৈতিক সচেতনতা। হাজার হাজার মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত গণতন্ত্র যেন আর কখনো কোন দলীয় ফাঁদে না পড়ে। এই আন্দোলনের চেতনা হতে হবে ভবিষ্যতের প্রতিরোধ ও পুনর্গঠনের প্রেরণা। মনে রাখতে হবে, ফ্যাসিস্ট পতনের যে দ্বার খুলেছে, সেই দরজায় যেন প্রবেশ করে শুধু আলো আর আলো, কোন অন্ধকার নয়।
লেখক, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
পূর্বকোণ/জেইউ/পারভেজ