চট্টগ্রাম রবিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধে গোটা জাতিকে অনুপ্রাণিত করে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা

নাসির উদ্দিন

২৬ মার্চ, ২০২৫ | ২:৫৪ অপরাহ্ণ

জাতিগতভাবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম। একইসাথে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে চট্টগ্রামের রয়েছে বিশাল ভূমিকা। এই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকেই আসে স্বাধীনতার ঘোষণা। আর সেই ঘোষণাটি আসে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে। ‘উই রিভোল্ট’ বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণাটিও দেন এই চট্টগ্রাম থেকে। সেটিও করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে অকস্মাৎ গর্জে ওঠলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতিয়ার। নিরস্ত্র, নিরপরাধ, ঘুমন্ত জাতির উপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। বেঘোরে প্রাণ হারালো অগণিত মানুষ। তাদের আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠলো আকাশ-বাতাস। রাজপথ, অলি-গলিতে বয়ে গেল রক্তের স্রোতধারা। রাজনৈতিক নেতৃত্বহীন, অপ্রস্ত্তুত, অসংগঠিত, জাতি তখন কিংকর্তব্যবিমূড়। ঠিক সেই মুহূর্তে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এলো একটি বজ্রকণ্ঠ “আই মেজর জিয়া ডু হিয়্যার বাই ডিক্লেয়া্র্ড দ্য ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ, অল আর্মি অফিসিয়ালস, ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, পুলিশ, আর রিকোস্টেড টু এটেন্ড ইন কালুরঘাট ব্রীজ। সো ডেট উই ক্যান এসেম্বেল এ্যান্ড ফরোয়ার্ড ফ্রিডম ফাইট”।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ভাসমান, সৈনিক জিয়া তখন হাল ধরলেন। আশাহত, শংকিত জাতিকে আশা জাগানিয়া গান শোনালেন। তিনি ঘোষণা করলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। জিয়াউর রহমান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাঙালি সৈন্যদের একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর সকলকে একত্রিত করে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা জিয়াই করেছিলেন। স্বাধীনতা ঘোষনার পরপরই চট্টগ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তিনি। এখান থেকে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সকল ক্যান্টনমেন্টে তিনি যোগাযোগ স্থাপন করেন। বাঙ্গালি সেনাদের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেন।
তাই দেশের লাল সবুজ পতাকার সাথে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের নাম। এখান থেকে দুইবার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং একবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নান। বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামরিক-বেসামরিক লোকজনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে ত্রিশ লাখ শহীদ ও লাখো মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধীনতা। বাংলাদেশ আজ ফ্যাসিবাদ মুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বাস্তবায়ন হয়নি এখনো।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা সামরিক ও বেসমারিক সব পেশার লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা নয়, এখান থেকে প্রচার করা দেশাত্ববোধক গান মুক্তিকামী লোকজনকে আন্দোলিত করে। ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নান। এ সময় আওয়ামীলীগ নেতারা জানতে পারেন, জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে নাসিরাবাদ ২নং গেইট এলাকায় অবস্থান করছেন। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত হতে চান। এ খবর পেয়ে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতারা জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বললে তখন তিনি তাতে রাজি হন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
কিন্তু লিখিত কিছু না থাকায় জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে না বলে তার মতো করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ায় আওয়ামীলীগ নেতাদের তা পছ্ন্দ হয়নি। পরে এ কে খান একটি লিখিত বক্তব্য তৈরী করে দেয়ার পর ২৭ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। এর ১০মিনিট পর পাকিস্তানী হানাদার বহিনী কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে হামলা চালায়।
রাতেই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দস্যরা মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে নাসিরাবাদে প্রথম পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। স্বাধীনতা ঘোষণার সময় আরো কয়েকজন আওয়ামীলীগ নেতার সাথে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য মীর্জা আবু মনসুর।
আওয়ামীলীগ নেতা এম এ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণা জাতিকে তেমন নাড়া দেয়নি। তাই জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন হয়। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা গোটা জাতিকে নিঃসন্দেহে অনুপ্রাণিত করেছে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডাক্তার মাহফুজুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডাক্তার মাহফুজুর রহমান এও বললেন, একাত্তরের ২৫ মার্চ কালো রাতে চট্টগ্রাম ছিল ব্যাতিক্রম। ওই কালো রাতে সারা দেশে গণহত্যা হলেও সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের কারণে চট্টগ্রামে ওইরাতে গণহত্যা হয়নি। রাজপথ তখন দখলে ছিল স্বজ্ঞানে বিদ্রোহে জড়ানো সেনাবাহিনীর।
‘উই রিভোল্ট’ বলে তখন জিয়াউর রহমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে বেরিয়ে যান। সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে ষোলশহরের পাশে তৎকালীন টিসিবি গোডাউন বর্তমানে বিপ্লব উদ্যানের পাশে অবস্থান করেন।তাঁরা তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত হতে চাইছেন। এম এ হান্নানের স্বাধীনতা ঘোষণায় তেমন কাজ না হওয়ায় বিকল্প কাউকে খুঁজছিল আওয়ামলীগ নেতৃত্ব। সৈনিকদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে আসা জিয়াউর রহমানের অবস্থান বিপ্লব উদ্যানে। বিষয়টি জেনে আওয়ামলীগ নেতারা তাঁর সাথে যোগাযোগের জন্য পাঠান সংসদ সদস্য মীর্জা আবু মনসুরকে। তখন মেজর জিয়া বসা ছিলেন তাঁর জীপে। মাগরিবের সময় পরিচয় দিয়ে তাঁর সাথে কথা বলেন, মীর্জা আবু মনসুর। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতা ঘোষণার আহবান জানালে তিনি সাথে সাথে রাজি হন।পরে তাদের সাথে যোগ দেন আওয়ামীলীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার ও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে নিয়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান। বেতারের সিগন্যাল ওপেন করা হয়। এসময় আওয়ামীলীগ নেতারা জিয়াউর রহমানকে কোন ব্রিফ করেননি। লিখিত কোন বক্তব্য তখন প্রস্ত্তুত ছিল না। তারা বসে ছিলেন। মেজর জিয়া নিজ থেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
শেষে তা পছন্দ হয়নি আওয়ামীলীগ নেতাদের। প্রথম ঘোষণায় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বলা হয়নি। ফলে লিখিত বক্তব্য দেখে ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। এই লিখিত বক্তব্য তৈরীর জন্য নগরে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে মীর্জা আবু মনসুর ফটিকছড়িতে এ কে খান এর শ্বশুর বাড়িতে যান। সেখান থেকে এ কে খান একটি লিখিত বক্তব্য তৈরী করে দেওয়ার পরদিন জিয়াউর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জিয়াউর রহমান যেভাবে চিন্তা করতেন, সেটা অন্যরা করেননি। জিয়াই প্রথম চিন্তা করলেন পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ফলপ্রসু আঘাত হানতে হলে ‘রেগুলার ওয়েল ট্রেইন্ড আর্মি’ দরকার। সেই লক্ষ্যে তিনি ব্রিগেড গঠন করেন। ভারতীয়রা প্রথমে রাজি হননি। জিয়াউর রহমান তা অগ্রাহ্য করে প্রথম ব্রিগেড গঠন করেন। এবং তার নাম দেন তাঁর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে ‘জেড ফোর্স’। এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী ব্রিগেড। ‘জেড ফোর্স’র সদস্যরা রণাঙ্গনে অনেক গৌরবদীপ্ত ভূমিকা রেখেছে। এ্ই ফোর্স স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সাহসিকতার পদক অর্জন করে। ফলে আত্নদান ও শহীদের সংখ্যাও ছিল বেশি এই ফোর্সে।
কবিও সাংবাদিক আহমদ মুসার ভাষায় বলতে হয়: “তিনি ছিলেন আমৃত্যু সৈনিক। কেবল বার বার বদলে গেছে তার রণাঙ্গন। তার রণক্ষেত্র ব্যাপৃত ছিল বারুদের সশস্র গর্জনতা থেকে ভূমির মায়াবি বুকের সোনালী শস্য পর্যন্ত,খালের প্রবাহিত কলধ্বনি স্বচ্ছ জলরাশি থেকে অশীতপর বৃদ্ধার আবেগের অশ্রুবিন্দু পর্যন্ত। তাঁর প্রত্যয় ছিল পরদেশের আধিপত্য থেকে মুক্ত থাকার এবং সেই জন্যই হয়তো ভিনদেশি গোয়েন্দা উচ্চেদ তালিকায় লিপিব্ধ ছিল তার নাম। বার বার বদলে গেছে তার রণক্ষেত্র। পরিবর্তন করতে হয়েছে যুদ্ধাস্র। প্রতিটি রণাঙ্গনে লড়ে গেছেন নিপুন যোদ্ধার মতো পিছু হটে। অস্ত্র বারুদের উদ্দাম গর্জনতার মধ্যে তার দুরন্ত সাহস, জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় একাত্তরে আমাদেরও সাহসী করে তুলেছিল। ইথারে ভেসে আসা তাঁর কণ্ঠের কয়েকটি পংক্তি হয়ে পড়েছিল প্রেরণা ও সাহসের উৎস। সেই প্রথম জানতে পারি তাঁর কথা। আমাদের সম্মান শ্রদ্ধার মিছিলে যুক্ত হয়েছিল তাঁর নাম জিয়াউর রহমান”। বি: দ্র: মুক্তমঞ্চে প্রকাশিত লেখা- মতামতের দায় লেখকের।

লেখক : ব্যুরোচিফ, বাংলাভিশন, চট্টগ্রাম

পূর্বকোণ/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট